ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক স্থাপন

বিটিসিএল পুরোনো পথে, কারসাজি আরেক প্রকল্পে

দেশের সর্বত্র নিরবচ্ছিন্নভাবে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথ পৌঁছাতে স্বয়ংক্রিয় ও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক স্থাপনের কাজ অনিয়ম, কারসাজি ও বারবার দরপত্র ডাকার চক্করে পড়েছে। এতে প্রকল্পটি কবে বাস্তবায়িত হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।


সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে প্রকল্প বাস্তবায়নে যুক্ত বিটিসিএল কর্তৃপক্ষ পদে পদে অনিয়ম ও আইনবিধি লঙ্ঘন করে দরপত্র বাতিল করেছে। প্রকল্পটি সরকার অনুমোদন দেয় দুই বছর দুই মাস আগে। মেয়াদ বাকি আর আড়াই মাসের মতো। এখন পর্যন্ত কাজের কাজ কিছুই হয়নি।


বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) বিরুদ্ধে এমন অনিয়মের অভিযোগ নতুন নয়। এর আগে সংস্থাটি প্রায় একইভাবে দুটি প্রকল্পে কারসাজির আশ্রয় নিয়েছিল বলে অভিযোগ আছে। নতুন করে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে ডিজিটাল কানেক্টিভিটি শক্তিশালীকরণে সুইচিং ও ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক উন্নয়ন (এসটিএন) প্রকল্পে।

নথিপত্রে দেখা যায়, সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নের এই প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদিত হয় ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। ট্রান্সমিশন যন্ত্রপাতির ব্যয় ধরা হয় ৪০ লাখ ১৮ হাজার মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৪ কোটি টাকার কিছু বেশি।


অনুমোদনের পর প্রতিটি অন্তত ১০০ গিগাবাইট ব্যান্ডউইডথ পরিবহনে সক্ষম ৩০টি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি স্থাপনে ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক দরপত্র ডাকা হয়। এতে অংশ নেয় পাঁচটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে তিনটি চীনা কোম্পানি—হুয়াওয়ে টেকনোলজিস, জেডটিই করপোরেশন ও উহান ফাইবারহোম। এরা নিজস্ব যন্ত্রপাতি স্থাপনের প্রস্তাব দেয়। দেশীয় দুটি কোম্পানি টেক ভ্যালি ও এক্স-ফার যুক্তরাষ্ট্রের সিসকো ও ইনফিনেরার যন্ত্রপাতি সরবরাহের প্রস্তাব দেয়।


দরপত্র মূল্যায়নের জন্য ২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি সাত সদস্যের কমিটি গঠিত হয়। সর্বসম্মত মূল্যায়নে এক্স-ফার নামের একটি প্রতিষ্ঠান কারিগরিভাবে যোগ্য বিবেচিত হয়। বাকি চারটি প্রতিষ্ঠান অযোগ্য বিবেচিত হয়। এক্স-ফারের দর প্রাক্কলিত মূল্যের চেয়ে ৮ দশমিক ৭১ শতাংশ কম থাকায় সরকারি ক্রয় আইন, বিধি ও দরপত্রের শর্তানুযায়ী চুক্তির সুপারিশ করে মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এতে কমিটির সদস্যসচিব ও দুই বহিঃ সদস্য সই করেন। কিন্তু কমিটির সদস্য বিটিসিএলের তিনজন ও মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা পুনঃ দরপত্র আহ্বানের মত দেন। তাঁরা দাবি করেন, যন্ত্রপাতির বাজারদর আরও কম হতে পারে। এ ক্ষেত্রে তাঁরা দরপত্রে অযোগ্য প্রতিষ্ঠানের দর থেকে বাজারমূল্যের ধারণা নেন এবং সেটার সঙ্গে যোগ্য প্রতিষ্ঠানের দাম তুলনা করে দ্বিমত পোষণের যুক্তি তৈরি করেন। এর মধ্যে মূল্যায়ন প্রতিবেদনের কয়েকটি পৃষ্ঠার নম্বর হাতে কেটে ভিন্নমতের এই অতিরিক্ত দুই পাতা সংযোজন করা হয়।

নথিপত্রে দেখা যায়, সংযোজন-বিয়োজনসংবলিত প্রতিবেদনের পরিবর্তে বিটিসিএলের পরিচালনা পর্ষদের সভায় আলাদা কার্যপত্র উপস্থাপিত হয়। ১১ সদস্যের পর্ষদের সভাপতি ডাক ও টেলিযোগাযোগসচিব। ওই সভায় বিটিসিএল ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দরপত্র বাতিলের পক্ষে আর অন্য সদস্যরা বিপক্ষে অবস্থান নেন। টানাপোড়েনে পরবর্তী সভায় আলোচনার সিদ্ধান্ত হয়।


২০২০ সালের জুলাই মাসে পরের ভার্চ্যুয়াল সভায় (১৭৭তম সভা) সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দরপত্র বাতিল করে পুনঃ দরপত্রের সিদ্ধান্ত হয়। এতে দুজন সদস্য লিখিত দ্বিমত দেন। ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের প্রতিনিধি বিদেশ থাকার অজুহাতে তাঁকে ভার্চ্যুয়াল সভার জুম লিংক পাঠানো হয়নি। বুয়েটের প্রতিনিধি লিখিত ভিন্নমত না দেওয়ায় তাঁকে বাতিলের পক্ষে দেখানো হয়। ভিন্নমত প্রদানকারী পর্ষদ সদস্যদের বক্তব্য ছাড়াই সভার কার্যবিবরণীতে শুধু সিদ্ধান্ত তুলে ধরা হয়।
মূল্যায়ন প্রতিবেদন, ভিন্নমত পোষণ ও দরপত্র বাতিল বিষয়ে সরকারের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক এবং বর্তমান উপদেষ্টা এ কে এম ফজলুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, এই ক্ষেত্রে মূল্যায়নের জন্য প্রাপ্ত পাঁচটি দরপত্রের মধ্যে চারটি যথাযথ কারণে অযোগ্য হয়েছে। আইন ও বিধিতে ইচ্ছামাফিক দরপত্র বাতিলের সুযোগ নেই। এ ছাড়া অগ্রহণযোগ্য দরপ্রস্তাব আমলে নিয়ে কোনো মূল্যায়ন বা সিদ্ধান্তের সুযোগ সরকারি ক্রয় আইন ও বিধিতে নেই।

এদিকে যোগ্য দরদাতা রিভিউ প্যানেলে গেলে বিটিসিএল কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে যে দরপত্র বাতিলে সরকারি ক্রয়বিধি ও দরপত্র দলিলে বাতিলের একমাত্র ধারাটি বিবেচ্য হয়নি। কিন্তু রিভিউ প্যানেল রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয়। রিভিউ প্যানেলের এই পর্যবেক্ষণ বিটিসিএলের স্বীকারোক্তির সম্পূর্ণ বিপরীত বলে মন্তব্য করেন সিপিটিইউর প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক এ কে এম ফজলুল করিম।

যোগ্য দরদাতা রিভিউ প্যানেলেও প্রতিকার না পেয়ে আদালতে যান। বিষয়টি এখন সর্বোচ্চ আদালতে রয়েছে। সেখানে শুনানি অপেক্ষমাণ অবস্থায় ৭ এপ্রিল দ্বিতীয় পুনঃ দরপত্র গ্রহণ করে বিটিসিএল। এর আগে বহিঃ সদস্য বদল করে পুনঃ দরপত্র ডেকেছিল গত বছর ২০ সেপ্টেম্বর। সেটিও পরে বাতিল হয়ে গেছে।


বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, মূল্যায়ন কমিটির দ্বিধাবিভক্ত মত, সিপিটিইউর রায় ও পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তে তাঁরা আগের দরপত্র বাতিল এবং নতুন করে দরপত্র ডেকেছেন। প্রক্রিয়াটি চলমান।


বিটিসিএলের কর্মকর্তারা পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে এর আগে ২০১১ সালে একটি প্রকল্পে একই রকম কারসাজি করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তখন প্রকল্পটি ছিল অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগ ও উচ্চ ক্ষমতার ট্রান্সমিশন যন্ত্রপাতি স্থাপন নিয়ে। চার বছর ধরে ফাইল টানাটানির পর জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকা ঋণ প্রত্যাহার করে নিলে ২০০ কোটি টাকার প্রকল্পটি বাতিল হয়ে যায়। পরে ২০১৬ সালে সরকারি তহবিলের টাকায় আরেকটি প্রকল্প নেওয়া হয়। ছয় মাসের প্রক্রিয়ায় দরদাতা নির্বাচন করে চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে সেই দরপত্র বাতিল করা হয়। এরপর দরপত্র না ডেকেই চার দিনের মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এসবের প্রতিটি পর্যায়ে ক্রয় আইন ও নীতিমালা লঙ্ঘন করা হয়, যা পরে আদালতে প্রমাণিত হয় এবং যোগ্য দরদাতাকে ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।


এর বাইরে বিটিসিএলের মডার্নাইজেশন অব টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক (এমওটিএন) নামে আরেক প্রকল্পে উচ্চ মূল্যে কার্যাদেশ দেওয়ার মাধ্যমে সরকারের ৮০০ কোটি টাকার ক্ষতির অভিযোগ তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এদিকে বিটিসিএলের বিভিন্ন প্রকল্পে একের পর এক অনিয়ম-দুর্নীতির তদন্ত করেছে সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। ‘ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাগণের অপ্রতিরোধ্য দুর্নীতি প্রসঙ্গে’ শিরোনামে তাদের একটি প্রতিবেদন দুদক ও সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে গেছে। দুদক গত ২৫ মার্চ বিটিসিএলের কাছে প্রকল্পের নথিপত্র তলব করে চিঠি দিয়েছে। এ বিষয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, বিষয়টি যথাযথ স্থানে পেশ করা হয়েছে। দুদকের তদন্তে দুর্নীতি প্রমাণিত হলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


অবশ্য ব্যবস্থা যে নেওয়া হয় না, তা উঠে আসে সরকারি ওই সংস্থার প্রতিবেদনে। এতে বিটিসিএলের নতুন ও পুরোনো প্রকল্পের অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, বিটিসিএলের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণিত দুর্নীতির জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বদলে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এ কারণে তাঁদের মধ্যে দুর্নীতির ব্যাপারে অপ্রতিরোধ্য আচরণ দেখা যাচ্ছে।