বিজয় উৎসবে মানুষের ঢল

গায়ে জাতীয় পতাকার লাল-সবুজ রঙের পোশাক। মুখে বিজয়ের দৃপ্ত স্লোগান। গতকাল মহান বিজয় দিবসের প্রভাতে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ঢল নামে মানুষের l
ছবি: প্রথম আলো

বাড়িতে পতাকা, গাড়িতে পতাকা, দোকানপাট, অফিস-আদালত, এমনকি গালে-কপালেও পতাকা আঁকা। নগর, শহর, গ্রাম—সর্বত্র লাল-সবুজ সঙ্গে নিয়ে জাতি গতকাল বুধবার মহান বিজয় দিবস উদ্যাপন করেছে।
রাজধানী ঢাকায় বরাবরের মতো ভোরে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে দিবসের সূচনা হয়। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তারপর থেকে শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের উৎসব।
গতকাল ছিল সরকারি ছুটির দিন। সকাল থেকেই উৎসবমুখর মানুষের ঢল নেমেছিল রাজধানীর রাজপথে। জাতীয় পতাকা, ফেস্টুন এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় ছবি দিয়ে রাজপথ ও সড়কদ্বীপগুলো সুশোভিত করা হয়েছিল। পোশাক-আশাকে ছিল পতাকার রং লাল-সবুজের প্রাধান্য। বাবা-মায়েরা ছোট ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন বিজয় উৎসবে অংশ নিতে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংস্থা এবং নানা শ্রেণি-পেশার ও নানা বয়সী মানুষ জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।

উৎসবের মূল কেন্দ্র শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, রমনা উদ্যান ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘটেছিল বিপুল জনসমাগম। রমনা উদ্যান ও টিএসসি এলাকায় বিভিন্ন সংগঠন কনসার্ট ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। দোয়েল চত্বর থেকে শাহবাগ পর্যন্ত পথের দুই পাশে বসেছিল হরেক রকম কারুপণ্যের পসরা। বিভিন্ন সংগঠন ট্রাকে মঞ্চ করে শহর ঘুরে ঘুরে অনুষ্ঠান করেছে। আর সারা নগরেই বেজেছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিজাগানিয়া উদ্দীপনাময় সংগীত ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম...’। রবীন্দ্রসরোবর মঞ্চ কেন্দ্র করে ধানমন্ডি লেকের দুই পাড়ে এবং হাতিরঝিল, জাতীয় সংসদ ভবনের উভয় পাশ ও চন্দ্রিমা উদ্যানেও ছিল বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাগম।
সকাল সাড়ে ১০টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে বের হয়েছিল সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের বিজয় মিছিল। মিছিলটি শাহবাগ মোড় পর্যন্ত গিয়ে আবার শহীদ মিনারে ফিরে আসে। সকালে গুলশান এলাকায় ট্রান্সকম ফুডস লিমিটেড (টিএফএল) বর্ণাঢ্য বিজয় শোভাযাত্রার আয়োজন করে।

মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে গতকাল সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা l

বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বের হয় বর্ণাঢ্য বিজয় শোভাযাত্রা। এই শোভাযাত্রা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে গিয়ে শেষ হয়। উৎসবমুখর মানুষ ঘুরে, অনুষ্ঠান দেখে, কেনাকাটা করে, গান শুনে, আড্ডা দিয়ে সময় কাটিয়েছেন।
বেলা তিনটার দিকে বিএনপি নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে বিজয় শোভাযাত্রা বের করে, এটি শেষ হয় মালিবাগ মোড়ে গিয়ে।
বিজয় দিবস উপলক্ষে সকাল ১০টায় তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরের জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ছিল ঐতিহ্যবাহী কুচকাওয়াজ। বীর মুক্তিযোদ্ধা, সশস্ত্র বাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের অংশগ্রহণে এই বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজে প্রধান অতিথি হিসেবে সালাম গ্রহণ করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দুপুরের দিকে পথে পথে লোকসমাগম কিছুটা কমে আসে। কিন্তু বিকেল হওয়ার আগেই আবার পথে নামে উৎসবমুখর মানুষ। শহীদ মিনারে শুরু হয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের বিজয় উৎসবের অনুষ্ঠানমালা। কোটি কণ্ঠে জাতীয় সংগীতের আয়োজন ছিল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। বিজয় দিবস উদ্যাপন জাতীয় কমিটি আয়োজিত এই অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল বেলা ১১টায়। জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়েছে বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে। এখানে আরও ছিল সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ ’৭১-এর অনুষ্ঠান। টিএসসি এলাকায় ১৩টি সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের আয়োজনে তিন দিনের অনুষ্ঠানের ছিল সমাপনী আয়োজন। মল চত্বরে ছিল বাংলাদেশ ছাত্রলীগ আয়োজিত বিজয় কনসার্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে বেলা সাড়ে তিনটায় শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে ছায়ানটের অনুষ্ঠান। গানের সুরে মুখর হয়ে ওঠে এলাকা। সন্ধ্যা থেকে আলোকসজ্জা। মতিঝিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলসহ বিভিন্ন এলাকার ভবন ও সড়কদ্বীপে দৃষ্টিনন্দন এই আলোকসজ্জা দেখতে আসেন অনেকে।
জাতীয় স্মৃতিসৌধে মানুষের ঢল: দেশের পরাধীনতা ঘোচাতে যাঁরা জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সেই বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে লাখো মানুষের ঢল নেমেছিল গতকাল সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে। সকাল হওয়ার আগে থেকেই পুষ্পস্তবক নিয়ে স্মৃতিসৌধে আসেন তাঁরা।

সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও দলটির জ্যেষ্ঠ নেতারা l

ভোর সাড়ে ছয়টায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং তারপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় দিবসের কর্মসূচি। স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর পর তাঁরা কিছু সময় নীরবতা পালন করেন। পরে নেতাদের সঙ্গে নিয়ে দলের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এরপর জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ, সাংসদেরা, তিন বাহিনীর প্রধানেরা, ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক এবং মুক্তিযোদ্ধারা ফুল দিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।
এরপর সর্বস্তরের জনসাধারণের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় জাতীয় স্মৃতিসৌধের প্রবেশদ্বার। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে জনতার ভিড়।
বেলা ১১টার দিকে দলের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এ ছাড়া বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাসদ, বিকল্পধারাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক মানুষ শ্রদ্ধা জানান। অনেকে আসেন পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে।

তাঁদের অনেকের মুখে ছিল ‘জয় বাংলা’ স্লোগান, কেউবা স্লোগানে স্লোগানে জানিয়েছেন রাজাকারমুক্ত দেশ গড়ার প্রত্যয়। অনেকে দাবি তুলেছেন জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার।

আওয়ামী লীগ রাজধানীেত গতকাল বিকেলে বিজয় শোভাযাত্রা বের করে।
বিএনপি গতকাল রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে বিজয় শোভাযাত্রা বের করে l