আত্মপক্ষ

বিজয়ের দিনে ঢাকায়

কে এম সফিউল্লাহ বীরউত্তম
কে এম সফিউল্লাহ বীরউত্তম

৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব আর গোপন ছিল না—প্রকাশিত হয়ে পড়ে। জ্যাক অ্যান্ডারসন এ বিষয়টি বিশ্বের সামনে উন্মোচন করে দিয়েছেন যে যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তানকে সাহায্য করার জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাবে। উক্ত নীতি অনুযায়ী বিশাল শক্তিসম্পন্ন সপ্তম নৌবহরকে অজ্ঞাত উদ্দেশ্যে বঙ্গোপসাগরে প্রস্তুত থাকার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কাজেই, সম্মিলিত বাহিনীর প্রবল গতিময়তার ওপর প্রাধান্য আরোপ করা হয়।

মেজর জেনারেল এইচ এম আনসারীর ১৬তম ডিভিশনকে বিভিন্ন স্থানে পরিব্যাপ্ত অবস্থায় পদ্মা নদীর পশ্চিমাঞ্চলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১১তম কোর কোণঠাসা, বিচ্ছিন্ন এবং অবরোধ করে ফেলেছে। ভারতীয় ৩৩তম কোর হিলি দখল করে প্রবলবেগে যমুনা–পদ্মার মোহনায় উপস্থিত হয়েছে। ভারতীয় ১০১তম কমিউনিকেশন জোন যখন তুরা থেকে দক্ষিণ দিকে বিদ্যুৎগতিতে ঢাকার পথে অগ্রসর হয়, তখন সবকিছু ছাপিয়ে, দৃশ্যান্তরে, বৈদ্যুতিক রণকৌশল পাকিস্তান বাহিনীর মনোবলে ধস নামিয়ে দেয়। চূড়ান্ত পর্যায়ে, পূর্ব দিক থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর চতুর্থ কোরের তিন ডিভিশন সৈন্য তিনটি কলামে বিভক্ত হয়ে অগ্রসর হয়। উত্তর–পূর্বে এক ডিভিশনের কলাম শিলচর–সিলেট সড়কপথে সিলেটে পৌঁছায়। ‘জেড’ ফোর্স এই অভিযানের সঙ্গে সংযুক্ত। দক্ষিণ–পূর্বে আরেক ডিভিশন দুটি কলামে কুমিল্লা–চট্টগ্রাম দখলের জন্য সাঁজোয়া বহরে ছুটে চলে। এই অক্ষরেখায় ‘কে’ ফোর্সও সংযুক্ত ছিল। পূর্ব দিক থেকে ৫৭তম মাউন্টেন ডিভিশন এবং ‘এস’ ফোর্স দুর্বার গতিতে ভৈরবে এসে শত্রুদের অবরুদ্ধ করে এবং ঢাকা অগ্রসরের রাস্তায় পৌঁছে যায়। সারা দেশে এখানে–সেখানে সর্বত্র যেন সম্মিলিত বাহিনীর মহাপ্লাবনে পাকিস্তান বাহিনী চারদিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে।

রণাঙ্গণে কৃষক েযাদ্ধা, ১৯৭১

যখন ঢাকার চারদিকে পরিবেষ্টিত ফাঁস নজিরবিহীন গতিতে ঘড়ির কাঁটার মতো নিখুঁতভাবে সংকুচিত হয়ে আসছে, তখন ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এ এম মানেকশ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চল কমান্ডের উদ্দেশে প্রচারিত এক রেডিও বার্তায় পাকিস্তান বাহিনীর অবশ্যম্ভাবী আত্মসমর্পণের কথা পুনরায় ব্যক্ত করেন। এর ফলে পাকিস্তানি বহু কমান্ডার এবং সৈন্যের মনে ব্যাপকভাবে ভীতির সঞ্চার হয়। একটিমাত্র ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয় রাজধানী ঢাকায়, যেখানে লে. জেনারেল নিয়াজি অহমিকার সঙ্গে বললেন, ‘আমার মৃতদেহের ওপরই কেবল ঢাকার পতন হতে পারে।’ এ ঘোষণা পাকিস্তানিদের নিজেদের বাসভূমে প্রচারণা অভিযানের মূল্য বহন করে। বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনীর দ্বিতীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি হচ্ছেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। তিনি পাকিস্তানি সৈন্যদের নিরাপদ অপসারণের ব্যবস্থা করার জন্য জাতিসংঘের কাছে আবেদন জানান। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া খান তা বাতিল করে দেন। লে. জেনারেল নিয়াজি হচ্ছেন পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ বা প্রেসিডেন্টের প্রতিভূমাত্র। তিনি শুধু জেনারেল ইয়াহিয়ারই প্রতিধ্বনি করেন। তাঁর আশপাশে কিংবা বাংলাদেশের সর্বত্র যা ঘটে চলেছে, সে সম্পর্কে তিনি নির্বিকার।

১৬ ডিসেম্বরে সূর্য উদিত হয় দখলদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রসঙ্গ নিয়ে। ১৫ ডিসেম্বর, মিত্রবাহিনীর বোমাবর্ষণ সাময়িকভাবে বন্ধ করার জন্য লে. জেনারেল নিয়াজি স্বাক্ষরিত প্রস্তাবের সময়সীমা হচ্ছে ১৬ ডিসেম্বর, সকাল ৯টা পর্যন্ত। তদনুযায়ী একটি রেডিও–তরঙ্গ ব্যান্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লে. জেনারেল নিয়াজিকে আত্মসমর্পণ করা বা না করা সম্পর্কে তাঁর সিদ্ধান্ত উক্ত ব্যান্ডে প্রচার করার শর্তারোপ করা হয়। অবরুদ্ধ পাকিস্তান পূর্বাঞ্চল কমান্ড চূড়ান্ত সময়সীমা আরও ছয় ঘণ্টা বাড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করলে, জেনারেল মানেকশ তাঁর সম্মতি সকাল ১০টার সময় বেতারযোগে অবহিত করেন।

পরিস্থিতি এখন দ্রুত মোড় নেয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চল কমান্ডের প্রধান স্টাফ অফিসার মেজর জেনারেল জ্যাকব অপরাহ্ণ ঠিক একটার সময় আত্মসমর্পণের শর্তাবলিসম্পর্কিত দলিল নিয়ে হেলিকপ্টারে ঢাকায় পৌঁছান।

লে. জেনারেল নিয়াজি শর্তাবলিতে ২টা ৪৫ মিনিটে অনুস্বাক্ষর করলে আত্মসমর্পণ দলিলে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষরের সময়সূচি নির্ধারিত হয় ৪টা ৩০ মিনিট।

১টা ৪৫ মিনিটে ডেমরায় অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যরা সম্মিলিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। বেলা ২টায় ডেলটা সেক্টর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং আমাকে জানায় যে মিত্রবাহিনীর ৫৭তম মাউন্টেন ডিভিশন থেকে তার কাছে বার্তা এসেছে—বেলা ৩টা ৩০ মিনিটে কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে সম্মিলিত বাহিনীর প্রধান লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরাকে স্বাগত জানানোসহ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য। ৩১১তম মাউন্টেন ব্রিগেডিয়ার কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার মিস্ত্রাও অনুরূপ সংবাদ আমাকে পৌঁছায়। তাই মঈনকে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা হওয়ার নির্দেশ দিয়ে আমি রওনা হই।

ডেমরা–ঢাকা সড়ক তখনো নিরাপদ নয়। পরাজিত শত্রুবাহিনী ভীতসন্ত্রস্ত নার্ভাস হয়ে—আবার কখনো প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে, ট্রিগারের ওপর আঙুল রেখে বসে আছে। তার সৈন্যদের মধ্য দিয়ে আমার সহযাত্রী হিসেবে বিমানবন্দরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমি ডেমরা এলাকার পাকিস্তানি ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লে. কর্নেল খিলজিকে সঙ্গে নিলাম। প্রায় আড়াইটায় লে. কর্নেল খিলজির গাড়িতে করে পাকিস্তানি সৈন্যদের মধ্য দিয়ে রওনা হই এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে বাধাপ্রাপ্ত হই। লে. কর্নেল খিলজির সহায়তায় সেই বাধা অতিক্রম করে ৩টা ৩০ মিনিটে বিমানবন্দরে পৌঁছাই। ঢাকা বিমানবন্দর যুদ্ধবিধ্বস্ত মাঠের আকার ধারণ করেছে। তবু বিজয় দিবসে এর মধ্যে স্বাগতসূচক মৃদু হাসির ঝলক যেন ফুটে উঠেছে।

সম্মিলিত বাহিনী প্রধান লে. জেনারেল অরোরাকে যাঁরা সাদর সম্ভাষণ জানাতে এসেছেন, এদের মধ্যে লে. জেনারেল নিয়াজি হচ্ছেন সব দৃষ্টির কেন্দ্র। বিষণ্ন এবং অবদমিত তাঁর মুখাবয়ব। পরাজিত একজন সেনাপতিকে প্রত্যক্ষ করার মতো এ হচ্ছে এক অভিজ্ঞতা—এমন এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা—যিনি যুদ্ধক্ষেত্রেই শুধু পরাজয়ের গ্লানি স্বীকার করেননি, যাঁর রয়েছে আরও এক লজ্জাকর গণহত্যার সদ্য–অতীত ইতিহাসও।

তাঁর পরাজয় শুধু পরাজয়ই নয়—পরাজয়েও একধরনের দীপ্তি আছে—লে. জেনারেল নিয়াজির তা–ও ছিল না। আমি যখন তাঁর দিকে ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করি, তখন তাঁর পুরো অস্তিত্ব অবিন্যস্ত এবং সম্পূর্ণ কালিমালিপ্ত আকারে আমার দৃষ্টিতে ভেসে ওঠে।

আমাদের তেমন অপেক্ষা করতে হলো না। আকাশে দেখা গেল একটি হেলিকপ্টারবহর। টারমাকে অবতরণ করলেন সদলবল জেনারেল অরোরা। তাঁর দলে রয়েছেন বাংলাদেশ বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ (অপারেশন) গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল করিম খোন্দকার। বিমানবন্দরের অনুষ্ঠান পর্ব শেষে আমরা রমনা রেসকোর্সের উদ্দেশে রওনা হলাম (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান)।

রেসকোর্সে সমবেত বিশাল জনতার জয়ধ্বনি—জয় বাংলা—ধ্বনির মধ্যে আত্মসমর্পণ দলিলে সই করেন আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি, লে. জেনারেল, মার্শাল ল প্রশাসক, জোন বি এবং কমান্ডার, ইস্টার্ন কমান্ড (পাকিস্তান) এবং জগজিৎ সিং অরোরা, লে. জেনারেল, অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ, ইন্ডিয়ান অ্যান্ড বাংলাদেশ ফোর্সেস ইন দ্য ইস্টার্ন থিয়েটার। তারিখ, ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। এ হচ্ছে উৎসবের দিন। এ হচ্ছে আনন্দের দিন। এ হচ্ছে বিধাতার উদ্দেশে শুকরিয়া জ্ঞাপনের দিন। এ হচ্ছে এক সমুদ্র রক্ত থেকে উত্থিত বাংলাদেশের বিজয় দিবস।

আত্মসমর্পণ দলিলে সই করার অনুষ্ঠান পর্ব চলাকালের ঐতিহাসিক দৃশ্য তাকিয়ে দেখলাম। এ হচ্ছে সহসা আয়োজিত এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান। আমার সহযোদ্ধা সৈনিকদের নিয়ে যেদিন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি সেদিন থেকে ৯ মাস সমরে, শিবিরে, রণাঙ্গনে প্রতিমুহূর্তে উত্তেজনা, উৎকণ্ঠা, আনন্দ–বেদনা, আশা–নিরাশা, মৃত্যুভয় এবং সহযাত্রী বহু সৈনিকের মাতৃভূমির জন্য অকাতর জীবন দেওয়ার করুণ দৃশ্যজনিত ভয়াল মুহূর্তে ছিলাম। কখনো এতটুকু বিশ্রাম গ্রহণ করিনি—নিদ্রাহীনতা, ক্ষুধা, ক্লান্তির কাছে মাথা নত করিনি—মনে হচ্ছে, জাতির নিশাবসান শেষে আজ আমি ধন্য হলাম—সদ্য স্বাধীন হওয়ার লগ্নে উপস্থিত হতে পেরে, বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করার বিরল সম্মান পেয়ে, অভিভূত হলাম।

সূত্র: মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা ২০০৬

মেজর েজনারেল কে এম সফিউল্লাহ বীরউত্তম: সেক্টর কমান্ডার; দেশের প্রথম সেনাপ্রধান