শহরে কোথাও দাঁড়ানোর মাটি নেই। এখনো ৪ থেকে ৬ ফুট পানিতে তলিয়ে আছে সুনামগঞ্জ শহর। দোকানপাট, অফিস-আদালত সব জায়গায় পানি আর পানি। নৌকা ছাড়া যাতায়াতের কোনো সুযোগ নেই। স্কুল–কলেজ, মসজিদ, অফিস–আদালত, বাড়ির ছাদ, উঁচু সেতুসহ শহরের বহুতল ভবনগুলোতে কয়েক হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে বানভাসি মানুষ। কোনো কোনো স্থানে এক ঘরে ২০ থেকে ৩০ জন পর্যন্ত আশ্রয় নিয়েছেন। একে অন্যের জন্য এগিয়ে এসেছে মানুষ। যাঁদের উঁচু বাড়ি বা বহুতল ভবন আছে, তাঁরা অন্যদের আশ্রয় ও খাবার দিয়ে সহায়তা করছেন। বহুতল প্রতিটি বাড়ি যেন একেকটি আশ্রয়কেন্দ্র।
সুনামগঞ্জে চার দিন ধরে বিদ্যুৎ নেই। মুঠোফোনের নেটওয়ার্কও ঠিকমতো কাজ করছে না। বিচ্ছিন্ন এই জনপদে এখন খাবার ও বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট। মোমবাতি পাওয়া যাচ্ছে না। মানুষ ইচ্ছা করলেও জিনিসপত্র কিনতে পারছে না। শহরের সব দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তলিয়ে আছে। মানুষের এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন খাবার আর বিশুদ্ধ পানি। একে তো জিনিসপত্র নেই, তার ওপর রান্নাবান্নারও সমস্যা। বাসাবাড়ির চুলা পানির নিচে।
প্রথম আলোর এই প্রতিনিধির বাসা শহরের মোহাম্মদপুরে। এটি শহরের উঁচু এলাকা। তাঁর ঘরেও ৩ ফুট পানি ছিল। এখন পানি দেড় ফুটের মতো কমেছে। এই এলাকার সব বাড়ি পানিতে তলিয়ে আছে। গত তিন দিন বৃষ্টি ছিল। মানুষ বৃষ্টির পানি পান করেছে। আজ বৃষ্টি হয়নি। ঢলের পানি ময়লা, ঘোলা। দুপুরে এলাকার মসজিদে জেনারেটর দিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় পানি তুলে মাইকিং করে পানি আনতে বলা হয়। পরে কজন বুকসমান পানি ভেঙে গিয়ে কিছু খাবার পানি সংগ্রহ করেছেন।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
প্রায় তিন দিন ধরে সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন সুনামগঞ্জ জেলা শহর। বিদ্যুৎ ও মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক না থাকায় শহরসহ বিভিন্ন উপজেলার মানুষের সঙ্গে তাঁদের স্বজন ও পরিবারের লোকজনও যোগাযোগ করতে পারছেন না। তবে আজ রোববার থেকে বন্যার পানি কিছুটা কমছে। কিছু কিছু বাসাবাড়ির ছাদে মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় তিন দিন পর আজ দুপুরে তিনতলা একটি বাড়ির ছাদে বসে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক এই প্রতিবেদনটি ও কয়েকটি ছবি পাঠাতে পেরেছেন।
শহরের প্রবীণ ব্যক্তিরা বলছেন, এটি সুনামগঞ্জে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা। এত পানি, পাহাড়ি ঢল আগে কখনো দেখেনি মানুষ। বন্যায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত সুনামগঞ্জ সদর, ছাতক, দোয়ারাবাজার, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা। এসব উপজেলা ভারত সীমান্তঘেঁষা।
মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল আবেদীন (৭২) বলেন, ‘আমার বয়সে এত ব্যাপক বন্যা সুনামগঞ্জে দেখিনি। বন্যায় মানুষ যেভাবে একের বিপদে অন্যকে আশ্রয় দিয়েছে, সেটা দেখে এই বিপদের সময়ও চোখে পানি এসেছে। কোনো কোনো মানুষ চারতলা, তিনতলা বিল্ডিং (ভবন) অন্যদের জন্য ছেড়ে দিয়েছে। কেউ কেউ খাওয়াচ্ছে। বাড়িঘরে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধার করে আনছে অন্যরা। মানুষ মানুষের পাশে না দাঁড়ালে কী হতো, ভাবতে পারছি না। তবে বন্যার পর যে মানবিক বিপর্যয় দেখা দেবে, সেটা নিয়ে ভাবছি।’
একই এলাকার বাসিন্দা আছকির আলী সাতজনকে নিয়ে একটি নির্মাণাধীন ভবনে আশ্রয় নিয়েছেন। এখানে কোনো বিদ্যুৎ নেই। পানির ব্যবস্থা নেই। নিচে ইট মাথায় দিয়ে, কেউবা স্রেফ দাঁড়িয়ে থেকে সময় পার করছেন। এখানে শ্রমজীবী ৩৪টি পরিবারের লোকজন আশ্রয় নিয়েছেন। ভবনমালিক সালাউদ্দিন মাহবুবই তাঁদের দুই বেলা খাবার দিচ্ছেন। মাহবুব বলেন, ‘শুধু আমি না, এলাকার সব ঘরেই মানুষে ঠাসা। অন্যরাও তাই করছেন। এভাবে বিপদ আসবে এটা তো কল্পনাতেও ছিল না। মানুষ তো বুঝতেই পারেনি, কয়েক ঘণ্টায় এমন গজব নেমে আসবে।’
শহরের বনানীপাড়া এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী ইশতিয়াক আহমদ বললেন, এলাকায় একতলা কোনো বাসায় মানুষ থাকার মতো অবস্থা নেই। তাঁর দোকানের সব জিনিসপত্র সরানোর আগেই পানি ঢুকে নষ্ট হয়ে গেছে। তাঁর ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানান তিনি। ইশতিয়াক আরও বলেন, এমন কোনো ব্যবসায়ী নেই, যাঁর ক্ষতি হয়নি। এই ক্ষতি পোষানো কঠিন।
সুনামগঞ্জে গত ১৩ মে প্রথম দফা বন্যা হয়। মানুষ এ বন্যার ধকল সইতে না সইতেই চলতি মাসের ১০ তারিখ থেকে আবার শুরু হয় ভারী বৃষ্টি। একই সঙ্গে ভারতের মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জি থেকে নামে ব্যাপক পরিমাণে পাহাড়ি ঢল। ১৩ জুন থেকে আবার বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলো। ১৫ মে ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলা পুরোটাই প্লাবিত হয়। ১৬ জুন পানি প্রবেশ করে সুনামগঞ্জ পৌর শহরে। দুপুর থেকে শুরু হয় তুমুল বৃষ্টি। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে পুরো শহর প্লাবিত হয়ে যায়। রাতে মানুষ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটতে থাকেন। রাত পোহানোর আগেই শহরে ৫ থেকে ৬ ফুট পানি দেখা দেয়। আজ রোববার দিনে বৃষ্টি হয়েছে কম। এতে সামান্য পানি কমেছে।