খাগড়াছড়িতে ৭ খুনের এক বছর

বিচার নিয়ে চুপ স্বজনেরা

সকালবেলা বাড়ির সামনের বাজারে চা খেতে গিয়েছিলেন খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলার স্বাস্থ্য সহকারী জিতায়ন চাকমা। হঠাৎ বন্দুকধারীদের এলোপাতাড়ি গুলির মধ্যে পড়ে প্রাণ হারান তিনি। খাগড়াছড়ি শহরের স্বনির্ভর বাজারে সেদিন জিতায়নসহ নিহত হন সাতজন, যার মধ্যে চারজনই ছিলেন সাধারণ মানুষ।

জিতায়নের স্ত্রী প্রভাতি চাকমা বলছিলেন, ‘ঘরভিটে ছাড়া কিছুই রেখে যাননি স্বামী। পেনশনের টাকা দিয়ে কোনোরকমে দুমুঠো খেয়ে বেঁচে আছি। এই টাকা দিয়ে দুই মেয়েকে পড়াতে হচ্ছে। এখন বড় মেয়ের একটা চাকরি হলে সংসারে অভাব কিছুটা কমত।’ তবে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার নিয়ে কিছুই বলতে চান না প্রভাতি চাকমা।

এ মামলায় গত এক বছরে নিহতদের স্বজন, মামলার বাদী, প্রত্যক্ষদর্শী পাহাড়িদের কাছ থেকে একটি শব্দও বের করতে পারেননি তদন্ত কর্মকর্তারা। কেবল দু–একজন বাঙালি প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি নিতে পেরেছেন তাঁরা।

গত বছরের ১৮ আগস্ট সকালে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) একটি সমাবেশস্থলের কাছে বাজারে এলোপাতাড়ি গুলিতে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে ইউপিডিএফের তিন নেতা–কর্মীসহ ছয়জন নিহত হয়। এরপর পালাতে গিয়ে স্বনির্ভর বাজারের কিছু দূরে আরও একজন মারা যান।

ঘটনার পর পুলিশ বাদী হয়ে থানায় অজ্ঞাত ২০-২৫ জনকে আসামি করে মামলা করেছিল। এরপর ইউপিডিএফের নেতা মিটুন চাকমা বাদী হয়ে আদালতে ২৭ জনকে আসামি করে অপর একটি মামলা করেন। এ ছাড়া উচিন নামে অপর একজন আদালতে ৫৬ জনকে আসামিকে করে মামলা করেছিলেন। এই দুই মামলায় মূলত প্রতিপক্ষ আঞ্চলিক দলগুলোর নেতা–কর্মীদের আসামি করা হয়। ২০ সেপ্টেম্বর থানা-পুলিশ রজেন্দ্র ত্রিপুরা নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়েছিল। কিন্তু কোনো তথ্য পায়নি।

পরে ১৮ এপ্রিল ঘটনার তদন্তভার দেওয়া হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই)। পিবিআই এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত বড় কোনো তথ্য বের করতে পারেনি। গ্রেপ্তারও নেই। তদন্ত কর্মকর্তা ছাড়াও পিবিআইয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাক্ষ্য গ্রহণের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কেউ সাক্ষ্য দিতে রাজি হয়নি।

তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের পরিদর্শক আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেউ সাক্ষী দিতে আসে না। ভয়ে মুখ খোলে না। নিহতদের পরিবারের লোকজনও কথা বলেন না। সবার মধ্যে এক ধরনের ভয় কাজ করছে। তারপরও ঘটনার রহস্য বের করার চেষ্টা চলছে। ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করছি।’

তদন্ত কর্মকর্তাসহ পিবিআইয়ের একটি দল জুলাই মাসে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। মামলার বাদীর সঙ্গে কথা বলতে চেয়েও সফল হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে ইউপিডিএফের প্রচার সম্পাদক নিরন চাকমাকে ফোন করে পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া দায়িত্বশীল আরও দু–একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৫ সালে আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে পাহাড়ে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত বন্ধ হয়। এরপর ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর পাহাড়ের আঞ্চলিক দল ইউপিডিএফ ভেঙে ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক নামে নতুন একটি দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরপর ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর রাঙামাটির নানিয়ারচরে ইউপিডিএফের অনাদি রঞ্জন চাকমাকে হত্যার মধ্য দিয়ে নতুন করে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। মূলত ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক এবং জেএসএসের (এম এন লারমা) মধ্যে এই সংঘাত শুরু হয়।

এরপর একই বছর ৩ মে বড় ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটে রাঙামাটির নানিয়ারচরে। জেএসএস (এম এন লারমা) নেতা ও উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাকে হত্যা করা হয়। পরদিন তাঁর শেষকৃত্যে যাওয়ার সময় ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের প্রধান তপন জ্যোতি চাকমাসহ পাঁচজনকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার জের ধরে স্বনির্ভরে হত্যাকাণ্ড ঘটে বলে তখন ইউপিডিএফের একাধিক নেতা ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়।

এভাবে চলতে থাকে একের পর এক হত্যা। কোনো হত্যাকাণ্ডেরই এখন পর্যন্ত কিনারা হয়নি। সর্বশেষ বড় ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটে গত ১৮ মার্চ বাঘাইছড়িতে নির্বাচনী কর্মকর্তা বহনকারী গাড়িতে। এভাবে এখন পর্যন্ত খুন হয়েছেন ৬৬ জন। কোনো হত্যা মামলার তদন্তেই অগ্রগতি নেই।