বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ হবে তো

>
  • সরকার সুশাসন প্রতিষ্ঠাকে গুরুত্ব দিচ্ছে
  • পাশাপাশি বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধকেও গুরুত্ব দেওয়া উচিত
  • এটিকে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ভাবছেন মানবাধিকারকর্মীরা

টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠনের পর এই সরকারের সামনে ‘গুম’ ও ‘ক্রসফায়ারের’ মতো বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ এবং এ পর্যন্ত নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের হদিস বের করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়েছে। এটাকে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু বলে মনে করছেন মানবাধিকারকর্মীরা।

‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ অনেক পুরোনো। যার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু গত এক দশকে পরিস্থিতি পাল্টায়নি। বরং যুক্ত হয়েছে ‘গুম’ ও ‘গুপ্তহত্যার’ মতো আরও ভয়ংকর ঘটনা।

একই সময়ে উগ্র জঙ্গিগোষ্ঠীর নতুন করে উত্থান এবং তাদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটা বড় কারণ ছিল। সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী খুব দ্রুত জঙ্গিগোষ্ঠীকে মোকাবিলা করা এবং তাদের আইনের আওতায় আনার ক্ষেত্রে সাফল্যও দেখিয়েছে। কিন্তু ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ এবং গুম বন্ধে সেভাবে তৎপরতা দেখা যায়নি।

সাম্প্রতিককালে মাদক ও ধর্ষণের মতো অপরাধ দমনের ক্ষেত্রেও একই কৌশল প্রয়োগ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। গত বছরের মে মাসে মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর অনেকে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন এবং অনেকের লাশ উদ্ধার হয়। আসকের হিসাবে, এমন নিহতের সংখ্যা ২৯২ জন। এঁদের মধ্যে কক্সবাজারের সাবেক কাউন্সিলর একরামুল হককে ক্রসফায়ারের সময়কার একটি মুঠোফোনের অডিও প্রকাশ করে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করে পরিবার। এরপর মাদকবিরোধী অভিযান নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।

সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণ মামলার তিন আসামির লাশ উদ্ধার করা হয়, যাঁদের গলায় বাঁধা চিরকুটে লেখা ছিল ‘ধর্ষণের অপরাধেই’ তাঁদের এই পরিণতি। এর মধ্যে ঝালকাঠির ভান্ডারিয়ার এক আসামির লাশের সঙ্গে চিরকুটে লেখা ছিল: ‘ধর্ষকের পরিণতি ইহাই। ধর্ষকরা সাবধান। হারকিউলিস।’  গ্রিক পুরাণের বীর হারকিউলিসের নাম চিরকুটে আসার পর বিষয়টি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও আলোচিত হচ্ছে। এটা বিচার–বহির্ভূত হত্যার নতুন ধরন কি না, সে আলোচনাও উঠেছে।

এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গত শুক্রবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘হারকিউলিস’ নামে যে বা যারা ধর্ষণকারীদের হত্যা করছে, তদন্ত করে তার রহস্য উদ্ঘাটন করা হবে। তিনি বলেন, ধর্ষকেরা সমাজের শত্রু। তবে তাদের এই কায়দায় হত্যা নিন্দনীয়। ‘হারকিউলিস’ নামে যারা হত্যা করছে, তারা ভালো কাজ করছে না। এটা আইনসম্মত নয়।

মানবাধিকারকর্মীদের মতে, বিশ্বের যেসব দেশে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় এ ঘটনা ঘটছে, সেসব দেশে আদালত সব সময় ভুক্তভোগীদের পক্ষে সুবিচার করতে পারেন না। বিচারব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা কমে যায়। সমাজের ন্যায়বিচারের যে প্রতিষ্ঠানগুলো থাকে, সেগুলো একে অপরের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। মানুষের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ সঞ্চারিত হয়। তাই দেশের মানবাধিকারকর্মীরা মনে করছেন, সরকার দুর্নীতি দমন, সুশাসন প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন কল্যাণমূলক বিষয়কে যেভাবে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলছে, এর পাশাপাশি বিচারবহির্ভূত হত্যা বা গুমের মতো ঘটনা বন্ধ করাকেও অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।

‘হার্ট অ্যাটাক’ থেকে ‘ক্রসফায়ার’
বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ২০০২ সালে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে সারা দেশে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ অভিযান শুরু করে। ওই অভিযানে পঞ্চাশের বেশি মানুষ মারা যায়। তখন বলা হয়েছিল, জিজ্ঞাসাবাদের সময় ওই সব ব্যক্তিরা ‘হার্ট অ্যাটাকে’ মারা গেছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকে সরকারি দলের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। ব্যাপক সমালোচনার মুখে অপারেশন ক্লিন হার্ট ২০০৩ সালে বন্ধ হয়ে যায়।

এরপর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কথিত চরমপন্থীদের সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও খুনোখুনি বেড়ে যায়। যার প্রেক্ষাপটে সরকার ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) প্রতিষ্ঠা করে। এর কিছুদিন পর থেকেই ‘ক্রসফায়ার’ শব্দটি আলোচিত হতে থাকে। তখন চরমপন্থী আখ্যা দিয়ে নিরীহ ব্যক্তিও ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছে, এমন অভিযোগ উঠেছিল। পরে পুলিশও ক্রসফায়ারে যুক্ত হয়।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৪ থেকে ২০০৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চারদলীয় জোট সরকার আমলে ক্রসফায়ারে ৭৩৬ জনের মৃত্যু হয়। এঁদের মধ্যে ৫৪৪ জনই ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ার আগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।

২০০৭ সালে এক-এগারোর পটপরিবর্তন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পর ঘটনা কমলেও ক্রসফায়ার বন্ধ হয়নি। আসকের হিসাবে, ২০০৭-০৮ সালে, দুই বছরে ক্রসফায়ারে নিহত হন ২৫৬ জন।

সেই গল্প এখনো চলছে
গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে নিয়ে রাতের বেলায় অস্ত্র উদ্ধারে বের হলে বা তাঁর সহযোগীদের গ্রেপ্তার করতে বের হলে ওত পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা হামলা, গুলিবর্ষণ করে, তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আত্মরক্ষায় পাল্টা গুলি ছোড়ে। দুই পক্ষে বন্দুকযুদ্ধের সময় ক্রসফায়ারে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় বন্দী ব্যক্তি। ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের সব গল্প প্রায় এ রকম। ঘটনাস্থল থেকে কিছু অস্ত্র উদ্ধারও দেখানো হয়। ২০০৪ সালে শুরু হওয়া এই গল্প এখনো জারি আছে। কেবল ক্রসফায়ার-এর স্থলে কখনো কখনো ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘এনকাউন্টার’ শব্দ প্রতিস্থাপিত হয়েছে।

প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবতা
শুরু থেকেই দেশি সংগঠনগুলোর পাশাপাশি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো এসব ক্রসফায়ারকে বিচারবহির্ভূত হিসেবে চিহ্নিত করে এটা বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছে। অপরাধ দমনের এই পদ্ধতিটা যে ভুল, বেআইনি এবং চূড়ান্ত বিবেচনায় বিপজ্জনক—এমন মতও শুরু থেকেই উচ্চারিত হয়েছে গণমাধ্যমে, নাগরিক সমাবেশে।

জোট সরকার আমলে বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও অভিযোগ করা হয়েছিল, তাঁদের নেতা-কর্মীদেরও ক্রসফায়ারে হত্যা করা হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে বিরোধী দলে যাওয়ার পর একই অভিযোগ করেছিল বিএনপিও। যথারীতি বিএনপি সরকারের মতো পরবর্তী সরকারও অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে বলা হয়েছিল, দলটি ক্ষমতায় এলে বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করা হবে। তবে সেটার প্রতিফলন পরে আর দেখা যায়নি।

তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা তো আমরা করি না। আমাদের ওপর অ্যাটাক হলে আমরা কাউন্টার অ্যাটাক করি।’

আসকের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত পাঁচ বছরে ক্রসফায়ারে মোট নিহতের সংখ্যা ৩৮০ জন। তবে বছর অনুযায়ী পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এই পাঁচ বছরে ক্রসফায়ারের সংখ্যা ক্রমে কমেছে। ২০০৯ সালে ১২৫, ২০১০ সালে ৯৩, ২০১১ সালে ৬২, ২০১২-তে ৫৮ ও ২০১৩-তে ৪২টি ঘটনা ঘটেছে।

এরপর ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনের আগে দেওয়া আওয়ামী লীগের ইশতেহার থেকে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’র প্রসঙ্গটি বাদ পড়ে যায়। সর্বশেষ একাদশ সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারেও এ বিষয়টির উল্লেখ নেই।

গুম ও গুপ্তহত্যা
২০০৯ সালের পর ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা কমলেও এই সময়ে ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে গুম ও গুপ্তহত্যার ঘটনা। ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল রাতে ঢাকার বনানী থেকে বিএনপির নেতা ইলিয়াছ আলী নিখোঁজ হওয়ার পর গুমের ঘটনা ব্যাপক আলোচনায় এলেও এর শুরু ২০১০ সালে। ওই বছরের জুনে রাতে ঢাকা থেকে একইভাবে নিখোঁজ হন বিএনপি নেতা ও সাবেক কমিশনার চৌধুরী আলম। ওই বছর ঢাকা ও গাজীপুর থেকে নিখোঁজ হন বরিশাল ও চট্টগ্রামের বিএনপির দুই নেতা। ২০১১ সালে ঢাকা থেকে অপহৃত ও গুম হন খুলনা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি কে এম শামীম আকতার, ২০১২ সালে ইলিয়াছ আলী ও তাঁর গাড়িচালক ছাড়াও আরও তিনজন নিখোঁজ হয়েছেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে, অর্থাৎ ২০১৩ সালের শেষ দিকে এ ধরনের ঘটনা বেড়ে যায়। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে এক রাতেই ঢাকার নাখালপাড়ার ছয়জনকে তুলে নেওয়া হয়। অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় লাকসামের সাবেক সাংসদ সাইফুল ইসলামসহ দুজনকে। যাঁদের খোঁজ আজও জানা যায়নি।

আসকের হিসাবে, ২০১৩ সালে ৫৮ জন অপহরণ ও গুমের শিকার হয়েছেন। ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর অভিযোগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোক পরিচয়ে তাঁদের স্বজনকে তুলে নেওয়া হয়েছে, এরপর আর কোনো খোঁজ পাননি তাঁরা। নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় যেভাবে র‍্যাবের একটি ব্যাটালিয়নের অধিনায়কসহ এতসংখ্যক কর্মকর্তা ও সদস্যের জড়িত থাকার বিষয়টি প্রকাশ পায় এবং আদালতে প্রমাণিত হয়, এরপর গুম ও গুপ্তহত্যার শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের সন্দেহ আরও তীব্র হয়।

২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনের পর গুমের সংখ্যা কমলেও বন্ধ হয়নি। পরবর্তী পাঁচ বছরেও অনেকে গুম হন। হংকংভিত্তিক এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি) ও দেশীয় মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৯ বছরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ৩৯৫ জন নিখোঁজ হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে তাঁদের মধ্য থেকে ৫২ জনের লাশ পাওয়া গেছে। ফিরে এসেছেন ১৯৫ জন। এর আগে-পরে ফিরে আসা ব্যক্তিরা আর মুখ খোলেননি।

আসকের হিসাবে, ২০১৮ সালেও অপহরণ, গুম ও নিখোঁজের শিকার হন ৩৪ জন। এর মধ্যে পরবর্তী সময়ে ১৯ জনের সন্ধান পাওয়া গেছে, যাদের অধিকাংশকে পরে বিভিন্ন মামলায় আটক করা হয়। সর্বশেষ গুম হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে সাবেক সেনা কর্মকর্তা হাসিনুর রহমান ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামানসহ কয়েকজন এখনো নিখোঁজ আছেন।

পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ক্রসফায়ার ও গুমের ক্ষেত্রে শুরুতে কথিত চরমপন্থীরা ছিল লক্ষ্যবস্তু। পরবর্তী সময়ে পেশাদার সন্ত্রাসী, ধর্মীয় উগ্রপন্থী, মাদক বিক্রেতা, রাজনৈতিক কর্মী, ব্যবসায়ী, বিভিন্ন পেশাজীবীরা এ ধরনের ঘটনার শিকার হয়েছেন।

উন্নয়নের স্বার্থে হলেও বন্ধ করতে হবে
মানবাধিকারকর্মী মো. নূর খানের মতে, সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়বিচারের স্বার্থে গত দেড় দশকে সংঘটিত ক্রসফায়ার ও গুমের ঘটনায় একটা স্বাধীন কমিশন গঠন করতে পারে। যাতে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এসব বেআইনি ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করা যায়।
বাংলাদেশে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছিল বিশ্ব সংস্থা জাতিসংঘও। ২০১৭ সালের ২৯ মার্চে প্রকাশিত জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশকে অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক গুম, অপহরণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো তদন্ত করে দেখতে হবে। ঘটনার শিকার নাগরিকদের যথাযথ সহায়তা দিতে হবে। সরকারের উচিত গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান করা এবং তাদের আত্মীয়দের তদন্তের অগ্রগতি জানানো।

বেশ কয়েক বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের ঘটনা এসেছে। এসব ঘটনায় বিভিন্ন সময়ে উদ্বেগ জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নও। এসব বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছে দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলোও।
তবে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বরাবরই বিচারবহির্ভূত হত্যা বা গুমের ঘটনা ঘটার কথা অস্বীকার করে আসছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবরই বলে আসছেন, দেশে গুম বলে কিছু নেই। অনেক সময় অপরাধী বা মামলার আসামিরা আত্মগোপন করে থাকেন, পরিবার দাবি করেন গুম।

তবে সরকার অস্বীকার করলেও দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলো মনে করে, এসব আছে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, যে ঘটাক, ঘটনাগুলো তো ঘটছে। এসব চলতে থাকলে দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়বে না। সরকারকে দেশের উন্নয়নের স্বার্থে হলেও এসব বন্ধ করতে হবে।

বিশেষজ্ঞ অভিমত
যারাই ঘটাক, তারা রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে
সুলতানা কামাল, মানবাধিকারকর্মী

সুলতানা কামাল

বিচারবহির্ভূত হত্যা কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। এ অবস্থার অবসান ঘটানোই সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে প্রায়ই দেশের কোথাও না কোথাও গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ পড়ে থাকছে। অনেক ক্ষেত্রে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়ার পর লাশ পাওয়ার খবর পেয়েছেন স্বজনেরা, এমন অভিযোগও রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী পরিবার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যের অনেক গরমিল দেখা যায়।

অনেকের কাছে খুব যুক্তিসংগত কারণেই সন্দেহ হচ্ছে যে গুপ্তহত্যার এসব ঘটনা রাষ্ট্রীয় কোনো বাহিনী করছে। আবার রাষ্ট্রীয় বাহিনী সেটা ক্রমাগতভাবে অস্বীকার করে যাচ্ছে। যে-ই ঘটনা ঘটাক, এটা তো বাস্তব, মানুষ গুম হচ্ছে, কারও কারও মৃতদেহ পাওয়া যাচ্ছে।

একের পর এক বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটলেও রাষ্ট্র বিষয়টিকে আমলে নিচ্ছে না। এ ধরনের ঘটনাগুলোর বিষয়ে রাষ্ট্রের একটা অস্বীকৃতির মনোভাব আমরা দেখতে পাই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে, তারা জানে না ঘটনাগুলো কীভাবে ঘটছে। কারা ঘটাচ্ছে, সে সম্পর্কেও তাদের ধারণা নেই।

কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে এই ঘটনাগুলো ঘটছে, এখন পর্যন্ত কয়টা ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হয়েছে এবং প্রকৃত সত্য কী, সে সম্পর্কে নাগরিকেরা খুব বেশি কিছু জানে না। আমরা জানতে পারছি না, কারা এসব ঘটিয়েছে? এটি আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি বিরাট চ্যালেঞ্জ। যারা ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে, তারা রাষ্ট্রের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে যে তারা এ ধরনের অপরাধগুলো করে যাবে।

যদি ধরে নিই যে এসব ঘটনা রাষ্ট্রবহির্ভূত মানুষজন করছে, রাষ্ট্রীয় কোনো বাহিনী করছে না, তাহলেও তারা রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে যে এই অপরাধগুলো আমরা করেই যাব এবং তোমরা এর কোনো সুরাহা করতে পারবে না। রাষ্ট্রীয় বাহিনী এই চ্যালেঞ্জকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে না। গুরুত্ব দিয়ে দেখলে তারা এর একটা সমাধানে পৌঁছাতে পারত। তারা তো নানাভাবে নানা কাজ করেছে, যেমন মাদকবিরোধী অভিযান চালাচ্ছে, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালাচ্ছে। সেখানে তো আমরা দেখছি পুলিশ বাহিনী কি করছে না করছে। সেসব ঘটনা তারা জনগণকে অবগত রাখছে।

অনেক সময় সরকারের দায়িত্বশীল লোকজন আলোচনায় আমাদের এমনও বলেছেন যে আমাদের এই কাজগুলো তো জনগণ সমর্থন করছে। অর্থাৎ পক্ষান্তরে তাঁরা স্বীকার করে নিয়েছেন যে এ কাজগুলো তাঁদের দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে। দায়িত্বশীল পদে থেকে এ কথা কী তাঁরা বুঝতে পারছেন না, তাঁরা কোনো না কোনোভাবে বিচারব্যবস্থাকে অবজ্ঞা করছেন। জনগণকেও এই বার্তাটাই দিচ্ছেন যে বিচার বিভাগ কোনো রকম কার্যকর ভূমিকা পালন করছে না, অতএব তাদের এই কাজগুলো করতে হচ্ছে। বিচার বিভাগকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি কিন্তু ঘটে যাচ্ছে। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে, সমাজে ন্যায়বিচারের যে প্রতিষ্ঠানগুলো থাকে, তাদের মধ্যে ভারসাম্যের প্রচণ্ড একটা গরমিল হয়ে যায়। এর কারণে যেটা হচ্ছে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো একে অপরের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছে। একে অপরের প্রতি অনাস্থা সৃষ্টি করছে এবং এর ফলে জনগণের মধ্যে একটা নিরাপত্তাহীনতার বোধ সঞ্চারিত হচ্ছে। তখন জনগণ এ ধরনের বিচারবহির্ভূত ঘটনা সমর্থন করে, নিজেরাও অনেক সময় নিজের পরিস্থিতিতে বা নিজের অবস্থানে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে। এটা সমাজে আইনশৃঙ্খলার জন্য বিপজ্জনক পরিস্থিতি।

তবে সরকার অনেক ভালো কাজও করছে, কিন্তু এসব কাজের জন্য ভালো কাজগুলো ম্লান হয়ে যায়। মাত্র পুলিশ সপ্তাহ শেষ হলো, আমি তাদের অভিনন্দন জানাই। আমাদের পুলিশ বাহিনী আমাদেরই দেশের সন্তান। আমাদেরই আত্মীয়স্বজন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহীদদের মধ্যেও এই পুলিশ সদস্যরা রয়েছেন। সে জন্য তাঁরা যখন প্রত্যাশামতো কাজটা না করেন, তখন সেটা আমাদের বেশি করে উদ্বিগ্ন করে তোলে। কেন তাঁরা করতে পারছেন না, এই প্রশ্নটাও আমি করতে চাই। তাঁদের আত্মসমীক্ষা করে দেখা উচিত কেন তাঁরা প্রত্যাশিত ভূমিকাটা পালন করতে পারছেন না।

সুলতানা কামাল: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী

আরও পড়ুন...