সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এস কে) সিনহার সোনালী ব্যাংক সুপ্রিম কোর্ট শাখার হিসাব বিবরণী আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। সোনালী ব্যাংক সুপ্রিম কোর্ট শাখার জ্যেষ্ঠ প্রিন্সিপাল অফিসার আতিকুল ইসলাম আদালতে এসব কাগজপত্র জমা দেন। আদালতকে এই ব্যাংক কর্মকর্তা জানান, ২০১৬ সালের ৯ নভেম্বর তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংকের দুটি পে–অর্ডারের মাধ্যমে তাঁদের শাখার গ্রাহক সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ব্যাংক হিসাবে মোট চার কোটি টাকা জমা হয়।
আতিকুল ইসলাম জানান, গত বছরের ৩০ জুলাই দুদকের পরিচালক বেনজির আহমেদ তাঁদের ব্যাংকে আসেন। বেশ কিছু কাগজপত্র জব্দ করেন, যা তাঁর কাছে জিম্মায় দিয়ে আসেন।
সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিরুদ্ধে করা দুদকের মামলায় সোনালী ব্যাংকের সুপ্রিম কোর্ট শাখার এই কর্মকর্তা ছাড়া আরও দুজন ব্যাংক কর্মকর্তা আজ মঙ্গলবার আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাঁরা হলেন সোনালী ব্যাংক সুপ্রিম কোর্ট শাখার জ্যেষ্ঠ প্রিন্সিপাল অফিসার সাখাওয়াত হোসেন ও সিনিয়র অফিসার আওলাদ হোসেন।
ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪–এর বিচারক শেখ নাজমুল আলম এই সাক্ষীদের জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ঠিক করা হয়েছে আগামী ৪ অক্টোবর। এ নিয়ে এই মামলার ১৮ জনের মধ্যে সাতজনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হলো।
কারাগারে থাকা তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংকের নিরীক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতীকে (বাবুল চিশতী) কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়।
আদালতে হাজির ছিলেন জামিনে থাকা মামলার আসামি ফারমার্স ব্যাংকের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ও সাবেক ক্রেডিটপ্রধান গাজী সালাহউদ্দিন, ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে এম শামীম, ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপন কুমার রায়, ভাইস প্রেসিডেন্ট লুৎফুল হক, টাঙ্গাইলের মো. শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা। মামলায় পলাতক চারজন। তাঁরা হলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা, ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখার ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সফিউদ্দিন আসকারী, ভাইস প্রেসিডেন্ট লুৎফুল হক ও এস কে সিনহার কথিত পিএস রণজিৎ চন্দ্র সাহা এবং রণজিতের স্ত্রী সান্ত্রী রায় (সিমি)।
আদালতে উপস্থিত ছিলেন আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল গনি ও শাহিনুর ইসলাম।
কীভাবে দুর্নীতি সংগঠিত হয়, সে ব্যাপারে মামলার বাদী দুদক কর্মকর্তা সৈয়দ ইকবাল হোসেন চলতি মাসে আদালতকে বলেছিলেন, ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর আসামি নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা ও শাহজাহান তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংকের (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) গুলশান শাখায় দুটি চলতি হিসাব খোলেন। পরদিন পৃথক দুটি হিসাবের বিপরীতে দুই কোটি করে মোট চার কোটি টাকা ঋণের আবেদন করা হয়। ঋণের আবেদনপত্রে ঠিকানা হিসেবে উত্তরার একটি বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করা হয়। যে বাড়ির মালিক সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। তৎকালীন ফারমার্স ব্যাংকের কর্মকর্তা মামলার আসামি জিয়াউদ্দিন আহমেদ, সফিউদ্দিন আসকারী ও লুৎফুল হক ঋণ আবেদন যাচাই-বাছাই না করে এই ব্যাংক এবং ব্যাংকের কোনো নীতিমালা না মেনেই ঋণ প্রস্তাব প্রস্তুত করেন। এতে নিজেরা স্বাক্ষর করেন। আসামে জিয়াউদ্দিন আহমেদ ঋণ প্রস্তাবটি হাতে হাতে ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে যান।
দুদক কর্মকর্তা বলেন, ফারমার্স ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তা স্বপন কুমার রায় কোনো যাচাই-বাছাই না করে ওই ঋণ প্রস্তাব দুটি অনুমোদনের জন্য নোট আকারে উপস্থাপন করেন। ব্যাংকটির ক্রেডিট শাখার গাজী সালাউদ্দিনের কাছে নিয়ে যান।
তিনিও কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই না করে ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে এম শামীমের কাছে নথিটি নিয়ে যান। ব্যাংকের ঋণ পলিসি নীতি অনুযায়ী এই ধরনের ঋণ অনুমোদনের ক্ষমতা ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের না থাকা সত্ত্বেও অবৈধ প্রক্রিয়ায় তিনি ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন করেন। পরদিন ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর আসামি শাহজাহান ও নিরঞ্জন সাহার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অনুমোদিত ঋণের টাকা সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নামে পে-অর্ডার ইস্যু করা হয়। ওই বছরের ৯ নভেম্বর সোনালী ব্যাংক সুপ্রিম কোর্ট শাখায় এস কে সিনহার ব্যাংক হিসাবে চার কোটি টাকা জমা হয়।
দুদক কর্মকর্তা সৈয়দ ইকবাল হোসেন আদালতকে বলেন, সোনালী ব্যাংক সুপ্রিম কোর্ট শাখায় টাকা জমা হওয়ার পর এস কে সিনহা বিভিন্ন সময় টাকা তুলে তা হস্তান্তর স্থানান্তর করেন। এর মধ্যে ওই বছরের ২৮ নভেম্বর দুটি চেকের মাধ্যমে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা তাঁর আপন ভাইয়ের শাহ্জালাল ব্যাংকের উত্তরা শাখার হিসাবে ১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা ও ৭৪ লাখ টাকা স্থানান্তর করেন। ওই টাকা ও পরে স্থানান্তর রূপান্তর করা হয়। মামলার আসামি রণজিৎ চন্দ্র সাহা এই ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনের সময়ে নিজে ব্যাংকে উপস্থিত থেকে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নাম উল্লেখ করে ভুয়া ঋণ অনুমোদনের ব্যবস্থা করেন। ঋণ আবেদনকারী নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা আসামি রণজিৎ চন্দ্র সাহার ভাইপো। অপর ঋণ আবেদনকারী শাহজাহান রণজিৎ চন্দ্র সাহার বাল্যবন্ধু। আসামি শাহজাহান ও নিরঞ্জন চন্দ্র সাহা দুজনই গরিব ও দুস্থ; তাঁরা ব্যবসায়ী নন।