সরকার বদল হলেই বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা বেড়ে যায়। এর আগে বিএনপির সরকারের সময় দেওয়া হয়েছিল ১০টি লাইসেন্স। এর মাত্র চারটি এখন চালু রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র বাংলাভিশনের মালিকানার কোনো পরিবর্তন হয়নি। বর্তমান আওয়ামী লীগের সরকারের সময় দেওয়া হয়েছে ১৬টি টিভির লাইসেন্স। এর মধ্যে চারটি চ্যানেলের মালিকানার বড় অংশ এরই মধ্যে বিক্রি করা হয়েছে
ফখরুল ইসলাম
৭১ টিভি: বর্তমান সরকারের আমলে লাইসেন্স পাওয়া ৭১ টিভির মালিকানার ৫০ শতাংশ বিক্রি করে দিয়েছেন মোজাম্মেল হোসেন। তিনি, তাঁর স্ত্রী, তাঁর ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী ও বাবার নামে থাকা ৫০ হাজার শেয়ার থেকে বর্তমানে আছে ২৫ হাজার শেয়ার। ২৫ হাজার শেয়ার মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল তাঁর নিজ নামে এবং এক ছেলে ও দুই মেয়ের নামে কিনে নিয়েছেন। দুই মেয়ে অবশ্য মেঘনা গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান তানভীর ফুড লিমিটেড ও ইউনাইটেড সল্ট ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিনিধিত্ব করছেন।
শেয়ার বিক্রির সঙ্গে যুক্ত একজন মধ্যস্থতাকারী জানান, ৫০ কোটি টাকায় ২৫ হাজার শেয়ার লেনদেন হয়েছে।
চ্যানেল ৯: চ্যানেল ৯-এর ৮৫ শতাংশ মালিকানা ২২ কোটি টাকা দিয়ে কিনে নেন এনটিভির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এনায়েতুর রহমান। এলজিআরডিমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের ভাই মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ শাফায়েতুল ইসলামের স্ত্রী সৈয়দা মাহবুবা আক্তারকে দেওয়া হয় এই টিভির লাইসেন্স। সৈয়দা মাহবুবা আক্তারের পাশাপাশি তাঁর স্বামী, ছেলে, ভাই, ভাইয়ের ছেলের নামে ছিল মোট শেয়ার। এই শেয়ার হাতবদল নিয়েও নানা অভিযোগ রয়েছে।
এনায়েতুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘চ্যানেল ৯-এর ৮৫ শতাংশ শেয়ার কিনে নিয়েছি। ২২ কোটি টাকার মধ্যে ২০ কোটি টাকা শেয়ারের দাম। বাকি দুই কোটি অন্য হিসাবে।’
সময় টিভি: সময় টিভির লাইসেন্স দেওয়া হয় আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামের ভাই চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলাম এবং তিন টিভি সাংবাদিক নিয়াজ মোরশেদ কাদেরী, তুষার আবদুল্লাহ ও আহমেদ জোবায়েরকে। লাইসেন্স পাওয়ার আট মাসের মাথায় ২০১০ সালের ৮ জুন সবাই মিলে ৫০ শতাংশ শেয়ার ২৫ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেন সিটি গ্রুপের চেয়ারম্যান ফজলুর রহমানের কাছে। এর পরই মোরশেদুল ইসলামের স্থলে নতুন চেয়ারম্যান হন ফজলুর রহমান। নিজের নামের পাশাপাশি স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে ও পুত্রবধূর নামে শেয়ার কেনা হয়।
এশিয়ান টিভি: এশিয়ান টিভির লাইসেন্স দেওয়া হয় এশিয়ান টেক্সটাইলের মালিক হারুন-অর-রশীদকে। ২০০৯ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর এশিয়ান টেলিভিশন চ্যানেল লিমিটেডের নামে নিবন্ধন নেন তিনি। তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদের ভাই ডা. মোফাজ্জল হোসেন, হারুন-অর-রশীদের মেয়ের শ্বশুর ও মন্ত্রীর চাচাতো ভাই জামিউল হোসেনও ছিলেন এতে। কিন্তু হারুন-অর-রশীদ লাইসেন্স নেন এশিয়ান টেলিকাস্ট লিমিটেডের নামে।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মিজানুর রহমান টাকা নিয়েও শেয়ার দেননি বলে অভিযোগ তুলেছেন আবাসন খাতের ব্যবসায়ী জসিমউদ্দিন। ১০ শতাংশ শেয়ারের জন্য ছয় কোটি টাকা দিয়েছেন জানিয়ে জসিমউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখনো মালিকানা বুঝে পাইনি।’
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে মিজানুর রহমান বলেন, ‘১০ শতাংশ শেয়ার ১৬ কোটি টাকায় বিক্রির চুক্তি করেছিলাম। তিনি ছয় কোটি টাকা দিয়েও পরে ফেরত নিয়ে গেছেন। তাই লিখে দেওয়া হয়নি।’
জানা গেছে, কর্মীদের নিয়মিত বেতন-ভাতা দেয় না এই চ্যানেল।
মোহনা টিভি: সরকারদলীয় সাংসদ কামাল আহমেদ মজুমদারকে দেওয়া হয় এই টিভির লাইসেন্স। তাঁর দুই ছেলে শাহেদ আহমেদ মজুমদার, জিয়াউদ্দিন আহমেদ মজুমদার, তাঁদের স্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাংসদ হামিদা বানু ও সজীব করপোরেশনের মালিক এম এ হাসেম এই চ্যানেলের পরিচালক।
লাইসেন্স পাওয়ার চার মাসের মাথায় ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বেলাল হোসেন ভুঁইয়া, সৈয়দ বজলুল করিম, মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন ও রবিন সিদ্দিক নামের চারজন তাঁদের পুরো শেয়ারই আমান গ্রুপের চেয়ারম্যান ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক এম আমানুল্লাহর কাছে বিক্রি করে দেন।
কত টাকা দিয়ে শেয়ার কিনেছেন জানাতে রাজি হননি আমানুল্লাহ। তবে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, চ্যানেলটি মূলত কামাল আহমেদ মজুমদারই পরিচালনা করেন। তিনি এর কোনো বৈঠকেও যান না।
এই চ্যানেলের সংবাদকর্মীদের বেতন-ভাতাও অনিয়মিত। চাকরিরও নিশ্চয়তা নেই এখানে।
বিজয় টিভি: চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগের নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী এই টিভির লাইসেন্স নিয়েছিলেন ২০০৬ সালে। কিন্তু বিধিসম্মত না হওয়ায় মহিউদ্দিন চৌধুরীর নামে মামলা হয় গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে।
বর্তমান সরকার নতুন করে লাইসেন্স দিলেও চালাতে না পেরে তিনি, তাঁর স্ত্রী হাসিনা মহিউদ্দিন ও ছেলে চৌধুরী মহিবুল হাসানের কিছু শেয়ার টাকা ছাড়াই এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী শেখ ঊর্মি রহমানের (ইভা রহমান) নামে লিখে দেন। সম্প্রতি তাঁদের কাছ থেকে পুরো শেয়ার ফেরতও নিয়ে আসে মহিউদ্দিন চৌধুরীর পরিবার।
বিজয় টিভির এমডি চৌধুরী মহিবুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘৩৫ শতাংশ শেয়ার মাহফুজুর রহমানকে দেওয়া হয়েছিল। বিস্ময়ের সঙ্গে দেখি, এর পরই তিনি আমাদের এড়িয়ে চলা শুরু করলেন। মতলব ভালো নয় বুঝে পরে ওই শেয়ার ফেরত নিয়ে এসেছি। চ্যানেলটি এখন আমাদের পরিবারের মালিকানাতেই রয়েছে।’ জানা গেছে, চ্যানেলটি নামকাওয়াস্তে চলছে। ঠিকমতো বেতন-ভাতা পান না এর কর্মীরা।
মাই টিভি: গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকেই এটি অবৈধভাবে চলে আসছিল। জানা গেছে, একসময় সৌদি আরবে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে চাকরি করতেন নাসিরউদ্দিন সাথী। বিয়ের অনুষ্ঠান ভিডিও করার জন্য ঢাকায় ‘ভিউ মিডিয়া’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান ছিল তাঁর। মাই টিভির মালিকানায় রয়েছে ভিএম ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি কোম্পানি। নাসিরউদ্দিনের স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যরা এর পরিচালক।
গত বিএনপির আমলে অনুমোদন ছাড়াই সম্প্রচার শুরু করে মাই টিভি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার তা বন্ধ করে দেয়। বর্তমান সরকারের আমলে নাসিরউদ্দিনকে মাই টিভির লাইসেন্স পাইয়ে দিতে ভূমিকা রাখেন সাংবাদিক নেতা আলতাফ মাহমুদ। যোগাযোগ করলে আলতাফ মাহমুদ লাইসেন্স নেওয়ার অংশ হিসেবে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত গিয়েছিলেন বলে প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেন। সংবাদকর্মীরা জানান, মালিকানা বিক্রির জন্য বিভিন্ন ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর সঙ্গে বৈঠক করলেও দরদামে বনিবনা হয়নি। অবিক্রীত রয়ে গেছে এখনো। নিয়মিত বেতন-ভাতা দেয় না এই চ্যানেল কর্তৃপক্ষ।
গানবাংলা ও দীপ্তবাংলা: গানবাংলা টিভির লাইসেন্স দেওয়া হয় রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী এম আমানুল্লাহ খানকে (চঞ্চল খান)। আবৃত্তিকার রবিশঙ্কর মৈত্রীসহ আরও পাঁচজন এর শেয়ারধারী।
সূত্র জানায়, সম্প্রতি শেয়ার বিক্রির জন্য আবাসন কোম্পানি আশিয়ান সিটির মালিক নজরুল ইসলামের সঙ্গে বৈঠক করেছেন গানবাংলার উদ্যোক্তারা। আশিয়ান সিটি পুরো চ্যানেলই কিনে নিতে চায়, কিন্তু চঞ্চল খান পুরোটা বিক্রি করতে রাজি হননি। দুজনের কাছে শেয়ার হস্তান্তরে বিটিআরসির কাছে আবেদন করলেও তারা কিছু জানায়নি।
এদিকে দীপ্তবাংলা টিভির লাইসেন্স পেয়েছেন পোলট্রি প্রতিষ্ঠান কাজী ফার্মসের মালিক কাজী জাহেদুল হাসান। পরিবারের সদস্যরাই এর মালিকানায়। কাজী জাহেদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রচারে আসতে একটু দেরি হচ্ছে। তবে শেয়ার বিক্রির চেষ্টা তিনি করেননি। লাইসেন্স পাওয়ার দুই বছর হতে চললেও সম্প্রচারে আসতে পারেনি এই দুই চ্যানেল।
অন্য ছয়টি: ইনডিপেনডেন্ট টিভির মোট এক লাখ শেয়ারের মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান সোহেল এফ রহমান ও ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানের নামে রয়েছে ৪০ হাজার করে শেয়ার। পরিবারের বাইরে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের ছেলে ভৈরবের সাংসদ নাজমুল হাসানের নামে শেয়ার রয়েছে ২০ হাজার।
এটিএন নিউজের লাইসেন্স দেওয়া হয় এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমানকে। তবে লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে সামনে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সাংবাদিক মনজুরুল ইসলাম। তিনি এখনো এই চ্যানেলের পরিচালক। পরে শেয়ার কিনে এই চ্যানেলের পরিচালক হয়েছেন বায়েজীদ গ্রুপের চেয়ারম্যান আবু বকর চৌধুরী এবং সৈয়দ সামিয়ুল হক নামের এক ব্যবসায়ী।
এসএ টিভির লাইসেন্স দেওয়া হয় এসএ পরিবহনের মালিক সালাউদ্দিন আহমেদকে। মালিকানায় রয়েছেন তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। সংবাদকর্মীরা জানান, বেতন-ভাতা নিয়মিত হয় না এবং পণ্যবাহী কুরিয়ার সার্ভিসের গাড়ি ব্যবহার করা হয় টিভি চ্যানেলের গাড়ি হিসেবে।
হা-মীম গ্রুপের চ্যানেল টোয়েন্টিফোর, স্কয়ার গ্রুপের মাছরাঙা টিভি এবং গাজী গ্রুপের জিটিভির কোনো শেয়ার বিক্রি বা হস্তান্তরিত হয়নি।