বগুড়া

বিএনপির ঘাঁটিতে সহিংস জামায়াত

বগুড়াকে বলা হয় বিএনপির ঘাঁটি। কিন্তু গতকাল শনিবার অবরোধ চলাকালে বগুড়া শহরের কোথাও বিএনপির আলাদা মিছিল-সমাবেশ চোখে পড়েনি। রাজপথে নেই দলটির নেতা-কর্মী। তবে শতাধিক মোটরসাইকেলের মহড়া করে শহরে স্লোগান দিয়েছে শিবির। পুলিশের সামনে ককটেল হামলাও হয়েছে।
রাজনৈতিক সহিংসতায় গত ১০ মাসে বগুড়ায় নিহত হয়েছেন ২৫ জন। জামায়াত-শিবিরের দাবি, এর মধ্যে ১৯ জনই তাদের নেতা-কর্মী।
বগুড়ার রাজনৈতিক দল, পুলিশ এবং সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক বছর ধরে বগুড়ার এমন চিত্র। বিএনপি সেভাবে রাজপথে নেই। কিন্তু নিয়মিতই সহিংসতা চালাচ্ছে জামায়াত-শিবির। বিএনপির আশ্রয়েই জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা এসব তাণ্ডব চালাচ্ছেন।
নির্বাচনের তফসিল স্থগিত ও নির্দলীয় সরকারের দাবিতে গত ২৬ নভেম্বর থেকে সারা দেশে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮-দলীয় জোট চার দফা অবরোধ কর্মসূচি দেয়।
বিকেল পাঁচটার দিকে শিবিরের বিক্ষোভ মিছিলের খবর ও ছবিসহ সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয় প্রথম আলোর বগুড়া অফিসসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের কার্যালয়ে। বিএনপির পৃথক কোনো কর্মসূচির খবর পাওয়া যায়নি। তবে মাটিডালি মোড় এলাকায় জামায়াতের সঙ্গে বিএনপিসহ ১৮-দলীয় জোট একটি সমাবেশ করে।
জামায়াতবিরোধী বলে পরিচিত জেলা বিএনপির কয়েকজন নেতা জানান, বগুড়া জেলা বিএনপির শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বিএনপির ঘাঁটি এখন জামায়াতের নিয়ন্ত্রণে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা বিএনপির সভাপতি সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জামায়াতের তো শুধু শিবির, কিন্তু আমাদের বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল সবাই মাঠে থাকে। আমরা তাদের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয়। তবে হয়তো সেভাবে চোখে পড়ে না।’ বগুড়ার সহিংসতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন করি। আমরা কারও বাড়ি পোড়াই না, পুলিশের ওপর হামলা চালাই না।’ সহিংসতা কারা করে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা আপনারাই দেখেন।’
জেলা জামায়াতের মুখপাত্র ও শহর শিবিরের প্রচার সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, ‘বগুড়া বিএনপির ঘাঁটি হলেও জামায়াত এখানে সমান্তরালেই কর্মসূচি চালাচ্ছে।’ আওয়ামী লীগের নেতা, সরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলা ও সাধারণ মানুষকে অবরুদ্ধ করে রাখা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলা চালাচ্ছি না। তবে পাঁচ বছর ধরে আওয়ামী লীগ যে অত্যাচার করেছে, তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে সাধারণ মানুষই তাদের ওপর হামলা চালাচ্ছে।’ তিনি দাবি করেন, সহিংসতায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৯ জনই জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী।
সংসদ নির্বাচনে বগুড়ার ইতিহাস থেকে জানা গেল, ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে সারা দেশে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও বগুড়ার নন্দীগ্রাম ও কাহালু নিয়ে গঠিত আসনটিতে জামায়াতের জেলা আমির আবদুর রহমান ফকির নির্বাচিত হন। বাকি ছয়টি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা জয়ী হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় জামায়াতের সঙ্গে।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ) আসনটিতে বিএনপিকে পরাজিত করে জয়ী হয় জামায়াতের শাহাদাত-উজ-জামান। বাকি ছয়টিতে বিএনপি জয়ী হয়। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে বগুড়ার সাতটি আসনের সবগুলোতে জয়ী হয় বিএনপি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে পাঁচটিতেই বিএনপি জয়ী হয়। বারবার নিজেদের প্রার্থী জয়ের কারণে বগুড়াকে বলা হয় বিএনপির ঘাঁটি। তবে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী না দিলেও বগুড়ার ১২টি উপজেলার মধ্যে তিনটির চেয়ারম্যান জামায়াতের। এ ছাড়া অনেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও তারা।
এ বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর সাজা হওয়ার পর বগুড়ায় সহিংস হয়ে ওঠে দলটি। গত ৩ মার্চ সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে—এমন গুজবে ভর করে বগুড়া সদর, নন্দীগ্রাম, শাজাহানপুর, শিবগঞ্জ, কাহালু, দুপচাঁচিয়া, গাবতলী ও শেরপুরে ব্যাপক সহিংসতা চালায় জামায়াত-শিবির। একযোগে বিভিন্ন থানা, পুলিশ ফাঁড়ি, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও নন্দীগ্রাম উপজেলা প্রশাসন ভসঞ্চীভূত করা হয়। এসব ঘটনায় অন্তত ১৮ জন প্রাণ হারান। মূলত মার্চের ওই ঘটনার পর থেকেই বিএনপির বদলে জামায়াত-শিবির বগুড়ার রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে। এরপর ১৮-দলীয় জোটের যত হরতাল-অবরোধ ও রাজনৈতিক কর্মসূচি হয়েছে, কার্যত সেখানে জামায়াত-শিবিরই বেশি সক্রিয় ছিল।
অবরোধ চলাকালে বগুড়া সদর, শাজাহানপুর ও শিবগঞ্জে সহিংসতায় মারা যান তিনজন। কুপিয়ে মারা হয় গণজাগরণ মঞ্চের বগুড়ার সংগঠক ও সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জিয়াউদ্দিন জাকারিয়াকে। এ ছাড়া অবরোধ চলাকালে বগুড়ার সাংসদ আবদুল মান্নান ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আসাদুর রহমানের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। হামলা থেকে রেহাই পাননি সংবাদকর্মী ও সংবাদপত্রের গাড়ি।
বগুড়া শহরকে অন্যান্য উপজেলা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে রাখে তারা। শহরের মাটিডালি মোড়, চারমাথা, এরুলিয়া, বারোপুর, তিনমাথা, ছিলিমপুর ও বনানীতে গাছের গুঁড়ি ফেলে রাখা হয়। শেরপুর থেকে শাজাহানপুরের বনানী মোড় পর্যন্ত গাছ ফেলে মহাসড়ক অবরোধের কারণে ঢাকার সঙ্গে বগুড়ার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির ঘটনায় শাজাহানপুর উপজেলার ফটকি সেতুটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে জামায়াত-শিবির।
অবরোধ হলেই শহরের মাটিডালি মোড় থেকে শিবগঞ্জের চণ্ডীহারা পর্যন্ত মহাসড়কে গাছ ফেলে বগুড়ার সঙ্গে রংপুর বিভাগের আট জেলা ও জয়পুরহাটের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। কেবল সড়ক-মহাসড়কই নয়, বগুড়ার বিভিন্ন স্থানে রেললাইন উপড়ে, রেললাইন কেটে ফেলে ট্রেন যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন করা হয়।
বগুড়া পৌরসভার প্যানেল মেয়র আমিনুল ফরিদ প্রথম আলোকে বলেন, এ বছরের মার্চ থেকে ১০ মাস ধরে জামায়াত-শিবিরের কাছে বগুড়াবাসী একেবারেই অসহায় হয়ে পড়েছে। মানুষ এখন ঘর থেকে বের হতেও ভয় পায়।
বগুড়ার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে জেলা পুলিশ সুপার মো. মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসামি গ্রেপ্তার করা হয় না—এমন অভিযোগ ঠিক নয়। এ পর্যন্ত ১৬৬ জন জামায়াত-শিবিরসহ ৬৭২ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। কিন্তু জামিন নিয়ে বেরিয়ে এসে তারা আবার সহিংসতা করছে। আর বিএনপির ঘাঁটি হলেও বগুড়ায় জামায়াত অনেক শক্তিশালী। এখানে আজিজুল হক কলেজের আশপাশের অনেক মেস শিবিরের নিয়ন্ত্রণে। আর টানা অবরোধের কারণে আমরা অন্যদিকে মনোযোগ দিতে পারছি না। তবে এবারের অবরোধে পরিস্থিতি অনেক স্বাভাবিক।’