সব ধরনের এলপিজির দাম নির্ধারণের এখতিয়ার শুধু বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি)।
প্রতি মাসে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলপিজি) দাম নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। কিন্তু কমিশন যে দাম নির্ধারণ করে, তা নিয়ে বরাবরই আপত্তি তুলে এলপিজি আমদানি করা বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে বেঁধে দেওয়া দরে বাজার থেকে এলপিজি গ্যাস (সিলিন্ডার) কিনতে পারেন না গ্রাহকেরা। এবার সরকারিভাবে উৎপাদিত এলপিজির দাম নির্ধারণের বিষয়টি বিইআরসির আওতার বাইরে রাখতে চিঠি দিয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।
বিইআরসির দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, উচ্চ আদালতের আদেশে এলপিজির দাম নির্ধারণ করে কমিশন। দাম নির্ধারণপ্রক্রিয়া থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠানকে আলাদা করার সুযোগ নেই। এ ছাড়া আইন অনুসারে, সব ধরনের এলপিজির দাম নির্ধারণের এখতিয়ার শুধু বিইআরসির।
গ্রাহক পর্যায়ে এলপিজি চাহিদার মাত্র ২ শতাংশ সরবরাহ করে সরকারি কোম্পানি এলপি গ্যাস লিমিটেড। দেশের বাজারে এখন সরকারি এলপিজির (সাড়ে ১২ কেজির সিলিন্ডার) দাম ৫৯১ টাকা। আর বেসরকারি ১২ কেজির দাম ১ হাজার ৩৩ টাকা।
এদিকে সরকারি এলপি গ্যাস কোম্পানির পক্ষে ১৯ সেপ্টেম্বর জ্বালানি বিভাগ বিইআরসিকে যে চিঠি দিয়েছে তার মূল কথা হচ্ছে, বিইআরসির দাম নির্ধারণ করে দেওয়ায় বাজারে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হচ্ছে না। এলপি গ্যাস লিমিটেড থেকে উৎপাদিত এলপিজির মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা বিইআরসির কাছে রাখতে চায় না জ্বালানি বিভাগ। এ ক্ষেত্রে বিইআরসির ক্ষমতা কমিয়ে এই দায়িত্ব বিপিসিকে (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন) দিতে চায় তারা।
বিইআরসির সদস্য (গ্যাস) মকবুল ইলাহী চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, জ্বালানি বিভাগের চিঠি তাঁরা পেয়েছেন। এটি যাচাই-বাছাই করে, আইনি দিক পর্যালোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
চিঠি দিয়ে আইন অবমাননায় সরকারের চরম পর্যায়ে পৌঁছানোর নমুনা দেখাল জ্বালানি বিভাগ।এম শামসুল আলম, ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা
এলপি গ্যাস লিমিটেডের এক কর্মকর্তা জানান, আগে দাম পরিবর্তনের জন্য বিপিসির কাছে প্রস্তাব পাঠাত এলপি গ্যাস লিমিটেড। এরপর বিপিসি চিঠি লিখত জ্বালানি বিভাগে। এতে অনেক সময় লাগত। দুই বছর আগে দাম নির্ধারণের দায়িত্ব পায় বিপিসি। এরপর থেকে তারাই নিয়মিত দাম সমন্বয় করত। গত এপ্রিল থেকে বিইআরসি দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে। দাম বাড়লে বা কমলে এলপি গ্যাস লিমিটেডের কোনো ক্ষতি নেই। তারা শুধু বিক্রি থেকে কমিশন নেয়। লাভ-ক্ষতি বিপিসির। তবে বিইআরসির নির্ধারণ করা দামে কোনো মুনাফা করতে পারছে না বিপিসি। এখন বাজারে বেসরকারি এলপিজির দাম বাড়তে থাকায় বিপিসি মুনাফা করার সুযোগ পেয়েছে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আনিছুর রহমান বলেন, বিইআরসি আমদানিকৃত এলপিজির জন্য দাম সমন্বয় করে। সরকারি এলপিজির দামের ক্ষেত্রে এটা কার্যকর হয় না। এটার দাম তাই বিইআরসির আওতার বাইরে রাখতে বলা হয়েছে। জ্বালানি তেলের দামও তো বিইআরসি নির্ধারণ করে না। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সরকারি এলপিজির মূল্য নির্ধারণ বিপিসির কাছেই থাকা উচিত।
তবে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, বিপিসির দুর্নীতি-অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ পুরোনো। সেসবের সুরাহা হচ্ছে না। এখন আবার বাড়তি মুনাফা করতে চাইছে গ্রাহকের কাছ থেকে। বিপিসি দাম নির্ধারণ করলে কোনো কিছু যাচাই-বাছাইয়ের সুযোগ নেই। এতে ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষিত হবে না।
দীর্ঘ সময়ে গ্রাহকের জন্য এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করতে পারেনি বিইআরসি। পেট্রোলিয়ামজাত পদার্থের খুচরা মূল্য নির্ধারণে একটি প্রবিধানমালার খসড়া তৈরি হয় ২০১২ সালে, যা এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি। বিষয়টি নিয়ে ২০১৬ সালে উচ্চ আদালতে যায় ক্যাব। তাদের করা এক রিট আবেদনের ভিত্তিতে এক মাসের মধ্যে গণশুনানির মাধ্যমে দাম পুনর্নির্ধারণ করে প্রতিবেদন দাখিল করতে গত বছরের ২৫ আগস্ট নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত। নির্ধারিত ওই সময়ের মধ্যে দাম নির্ধারণ করতে না পারায় আদালতের কাছে ক্ষমা চেয়ে সময় বাড়িয়ে নেয় বিইআরসি। এরপর গত ফেব্রুয়ারিতে গণশুনানির আয়োজন করে বিইআরসি। এপ্রিলে প্রথম দাম ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে প্রতি মাসে আমদানি মূল্যের ওপর ভিত্তি করে বেসরকারি খাতে দাম সমন্বয় করা হচ্ছে।
ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, এলপিজির দাম নির্ধারণ করার কথা বিইআরসির। তারা তা পালন না করায় উচ্চ আদালত তাদের বাধ্য করেছেন। আর এখন এমন একটি চিঠি দিয়ে আইন অবমাননায় সরকারের চরম পর্যায়ে পৌঁছানোর নমুনা দেখাল জ্বালানি বিভাগ।