আড়াই বছরে প্রায় ৭৫ লাখ বিদ্যুৎ–সংযোগ দিয়েছে আরইবি। এর মধ্যে প্রায় ২৮ শতাংশ সংযোগ দিয়েছে ‘আলোর ফেরিওয়ালা’।
শুরুটা ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলায়। বাড়ি বাড়ি যেতে শুরু করে একটি ভ্যান। কেউ চাইলেই তার বাড়িতে দিয়ে দেয় বিদ্যুৎ–সংযোগ, মাত্র পাঁচ মিনিটে। চার দিনে এভাবে সংযোগ পান ৫৪ জন গ্রাহক। এরপর এটি বন্ধ হয়ে যায়। এক সপ্তাহ পর শুরু হয় আবার; এবার সারা দেশে। ভ্যান থেকে গত আড়াই বছরে ঘরে বসে বিদ্যুৎ–সংযোগ পান প্রায় ২১ লাখ গ্রাহক।
বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ানো এই ভ্যানের নাম ‘আলোর ফেরিওয়ালা’। ২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর এটি শুরু করেন পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) সহকারী মহাব্যবস্থাপক শেখ আবদুর রহমান। দুর্নীতি কমাতে মধ্যস্বত্বভোগীর হাত থেকে গ্রাহকদের সুরক্ষায় এমন ধারণা আসে তাঁর মাথায়।
আরইবি বলছে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে গত জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে নতুন বিদ্যুৎ–সংযোগ পেয়েছেন ৭৪ লাখ ৭৯ হাজার ৭৫৫ জন গ্রাহক। এর মধ্যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে আলোর ফেরিওয়ালা বিদ্যুৎ–সংযোগ দিয়েছে ২০ লাখ ৫৮ হাজার ৪৪৩টি। তার মানে ২৭ দশমিক ৫২ শতাংশ সংযোগ এসেছে এভাবে।
আবদুর রহমান এখন আরইবির উপমহাব্যবস্থাপক, কাজ করেন বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলায়। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, শুরু করার চার দিন পর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারণে আলোর ফেরিওয়ালা সেবাটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ২০১৯–এর ৩ জানুয়ারি প্রথম আলোয় এ সেবা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই দিনই এক অনলাইন সভার মাধ্যমে সারা দেশের কর্মকর্তাদের এ কর্মসূচি চালুর নির্দেশনা দেন আরইবি চেয়ারম্যান।
এ বিষয়ে আরইবির চেয়ারম্যান মঈন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, শতভাগ বিদ্যুতায়নে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে আলোর ফেরিওয়ালা। এটি একটি সরাসরি সেবা। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে আলোর ফেরিওয়ালা। একটি বাড়িও যাতে বিদ্যুৎ–সংযোগের বাইরে না থাকে, সেই চেষ্টা করা হচ্ছে।
আরইবি বলছে, সারা দেশে এ সংস্থার আওতায় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি আছে ৮০টি। প্রতি সমিতির আওতায় ১০টি করে ভ্যান নামানো হয়। গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায় ৮০০ ভ্যান। এর ফলে নতুন বিদ্যুৎ–সংযোগ কর্মসূচি বাড়তি গতি পায়। নতুন সংযোগের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের গ্রাহকসেবা দেওয়া হয় এসব ভ্যান থেকে। বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, দেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান আরইবি। দেশে বর্তমানে চার কোটি বিদ্যুৎ গ্রাহকের মধ্যে ৩ কোটি ১৬ লাখের বেশি গ্রাহক আরইবির। মুজিব বর্ষে শতভাগ বিদ্যুতায়নের লক্ষ্যমাত্রায় বড় ভূমিকা রেখেছে এ সংস্থা। ২০১৯ সালে বিদ্যুৎ বিভাগের ‘সেরা উদ্ভাবনী’ কর্মসূচির পুরস্কার পেয়েছে আলোর ফেরিওয়ালা।
দেশের মোট ৪৬২টি উপজেলায় কাজ করছে আরইবি। এর মধ্যেই একটি সৌরবিদ্যুতের আওতায়। বাকি ৪৬১টির মধ্যে ২৮৮টি উপজেলাকে আনুষ্ঠানিকভাবে শতভাগ বিদ্যুতায়িত ঘোষণা করা হয়েছে। শতভাগ বিদ্যুতায়িত বাকি ১৭৩টি উপজেলা আগামী ১২ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধন করার কথা রয়েছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, বিনা পয়সায় বিদ্যুৎ পাওয়ার ধারণাটাই গ্রামের মানুষের ছিল না। তাই আরইবিকে ঘরে ঘরে গিয়ে বিদ্যুৎ–সংযোগ দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে অবৈধ লেনদেনের সুযোগ উঠে গেছে। আলোর ফেরিওয়ালা চালু থাকবে। অন্য বিতরণ কোম্পানিগুলোকেও এটি চালু করতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
আরইবি বলছে, একটি মোটরচালিত ভ্যানে করে মিটার, সার্ভিস ড্রপ তার, অফিশিয়াল রসিদ বই, জামানত জমা গ্রহণের রসিদ বই, আবেদন ফরম, দুজন লাইনম্যান, একজনজন ওয়্যারিং পরিদর্শক বা একজন জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিসহ গ্রাহকের দরজায় গিয়ে আবেদন গ্রহণ করেন। সব তথ্য, কাগজপত্র, ওয়্যারিং যাচাই করে সঠিক থাকলে প্রয়োজনীয় নির্ধারিত ফি স্পটেই গ্রহণ করে পাঁচ মিনিটের মধ্যে গ্রাহকের নতুন সংযোগ প্রদান করে। সংযোগ দেওয়ার পাশাপাশি গ্রাহকদের বিভিন্ন রকম সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান দিচ্ছে আলোর ফেরিওয়ালা।
গত বছর মার্চের শুরুতে রাজধানীতে ফেরি করে বিদ্যুৎ–সেবা চালু করে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি)। এতে নতুন সংযোগ দেওয়ার পাশাপাশি নানা সচেতনতামূলক প্রচার চালানো হয় ভ্যান থেকে। বিশেষ করে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে গ্রাহকদের সচেতন করতে বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হয়। ১৮টি বিতরণ সেবা অঞ্চলে তিনটি মিনি ট্রাকে করে এ সেবা চালু করা হয়। টানা ১০ দিন ধরে চলা এ কর্মসূচিতে প্রায় আড়াই হাজার গ্রাহক ঘরে বসে বিদ্যুৎ–সংযোগ পান। এরপর করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির জন্য সারা দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর এটি বন্ধ হয়ে যায়। এ বিষয়ে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, ফেরি করে গ্রাহকের কাছে যাওয়ার কারণে ভালো সাড়া পাওয়া গেছে। নতুন সংযোগ, লোড বৃদ্ধি, মিটার পরিবর্তন, ভুল সংশোধনসহ সব ধরনের সেবা দেওয়া হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে এ কর্মসূচি আবার চালু করা হবে।
বিদ্যুৎ খাতের ১ হাজার ৪০০ গ্রাহকের ওপর জরিপ চালিয়ে গত মে মাসে একটি প্রতিবেদন দেয় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিয়েশন কোম্পানি (আইআইএফসি)। এতে দেখা যায়, ৫২ শতাংশ গ্রাহক বিদ্যুৎ-সংযোগ নেন মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালের মাধ্যমে। মধ্যস্বত্বভোগীর এমন দৌরাত্ম্য বন্ধ করে জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে আলোর ফেরিওয়ালার মতো কর্মসূচি চালু থাকা দরকার বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, অধিকাংশ সংযোগ হয়েছে আলোর ফেরিওয়ালার বাইরে। সেখানে তো অনিয়ম বন্ধ করা যায়নি। সংযোগ দিলেও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত করা যায়নি। তাদের বিতরণ ব্যয় বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আরও বেশি সেবা দিতে আরইবিকে শহর এলাকায় তাদের সম্প্রসারণ বন্ধ করতে হবে। আরইবিকে ব্যবসায়ী বানানোর চিন্তা করলে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের গর্ব করার মতো আর কিছু থাকবে না।