সরেজমিন সিলেট নগর

বাড়িতে থাকার উপায় নেই, আশ্রয়কেন্দ্রে খাদ্যসংকট

নগরের কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও গলাসমান। আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মানুষেরা খাবারের জন্য তাকিয়ে আছে সহায়তার দিকে।

বুকসমান পানিতে মালামাল নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছে মানুষ। গতকাল দুপুরে সিলেট রেলস্টেশন এলাকায়
ছবি: আনিস মাহমুদ

সিলেট শহরের শাহজালাল উপশহর এলাকার জে ব্লকের বাসিন্দা সিদ্দিকুর রহমান। নৌকায় করে মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উপশহর মোড়ে আসেন তিনি। বৃষ্টিতে এর মধ্যে সবাই ভিজে গেছেন। নৌকায় থাকা তিনটি ব্যাগ নামাতে নামাতে তিনি বললেন, ‘যে অবস্থা দেখছি, আর বাসায় থাকতে পারলাম না। বাধ্য হয়ে বাসার সবাইকে নিয়ে বের হয়েছি। গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জের বাহুবলে চলে যাব।’

বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় সিলেট নগরের প্রায় সব এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত নগরের নতুন ২৫টি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। দেড় ঘণ্টার ব্যবধানে এসব এলাকায় হাঁটুসমান পানি দেখা দিয়েছে। আগে থেকে প্লাবিত এলাকাগুলোতে পানি উঠেছে কোমর থেকে গলাসমান।

এমন অবস্থায় নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছেন নগরের বাসিন্দারা। যাঁদের গ্রামের বাড়ি অন্য জেলায়, তাঁরা সেখানে চলে যাচ্ছেন। কেউ কেউ আশ্রয় খুঁজছেন আত্মীয়স্বজন আর পরিচিতজনদের বাড়িতে। বহুতল ভবনের নিচতলার বাসিন্দারা উঠে যাচ্ছেন দোতলা, তিনতলায়। আর যাঁরা কোথাও যাওয়ার জায়গা পাচ্ছেন না, তাঁরা ছুটছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। কিন্তু সরকারি সহায়তা না পৌঁছায় আশ্রয়কেন্দ্রের বাসিন্দারা ভুগছেন খাদ্যসংকটে। নিজেদের জমানো সঞ্চয় আর মানুষের সহায়তাই এখন তাঁদের ভরসা।

সিলেট শহরের শাহজালাল উপশহর, সোবহানীঘাট, মেন্দিবাগ, নাইওরপুল, মিরাবাজার, টিলাগড়, শেখঘাট, তালতলা, মাছুদীঘির পাড়, জামতলা, মির্জাজাঙ্গাল, বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, দাড়িয়াপাড়া এলাকার সড়কে এবং বাসাবাড়িতে পানি উঠেছে।

পরিবারের ছয় সদস্য নিয়ে সিলেট নগরের মিরাবাজার এলাকার কিশোরী মোহন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন যুবক সৈয়দ এমরান। গতকাল বেলা ১১টার দিকে হোটেলের কয়েকটি খাবারের প্যাকেট হাতে নিয়ে তাঁকে আশ্রয়কেন্দ্রে ঢুকতে দেখা যায়। এমরান বলেন, রাতে সবাই শুকনা খাবার খেয়েছেন। সকালে কেউ কিছু খাননি। এ জন্য একসঙ্গে সকালের নাশতা এবং দুপুরের খাবার হিসেবে ভাত নিয়ে এসেছেন। ভ্যান চালিয়ে ২০০ টাকা জোগাড় করেছিলেন, তা দিয়েই খাবারগুলো এনেছেন।

এমরান তা-ও পরিবারের সদস্যদের জন্য কিছু খাবার জোগাড় করতে পেরেছেন। একই আশ্রয়কেন্দ্রে পরিবার নিয়ে দুই দিন ধরে আশ্রয় নেওয়া মনসুর আলী (৭০) পড়েছেন আরও সংকটে। তিনি বলছিলেন, ‘দুই দিন ধরি বিল্ডিংঅ কোনোরকম আছি। ঘরে সব মালসামানা (মালামাল) পানির তলে। টাকাপয়সা যা রুজি করছি, ই কয় দিনে সব শ্যাষ। আশ্রয় পাইলেও খানি (খাবার) পাইরাম না। মানুষের কাছ তনে খুঁজিয়া চলরাম (চলছি)।’

নগরের যতরপুর এলাকার মুকিত মিয়ার কলোনিতে বসবাস মনসুর মিয়ার। তিন ছেলেসহ পরিবারের পাঁচজন মিলে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। রিকশা মেরামতের কাজ করা মনসুর আলী জানান, তাঁর বাড়ি সুনামগঞ্জে। বাড়িতে শুধু ভিটেমাটি আছে, আর কিছু নেই। এ জন্য জীবিকার তাগিদে প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি সিলেটে। গত বৃহস্পতিবার বিকেলে তিনি আশ্রয়কেন্দ্রটিতে উঠেছেন। কিন্তু খাবারের সংকটে পরিবার-পরিজন নিয়ে রয়েছেন বিপাকে।

আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে কতজন রয়েছে, সেটি বলা যাচ্ছে না। এখন সব কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সরকারিভাবে ৩০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে, কিন্তু বৃষ্টির মধ্যে সেগুলোও আনা হয়নি। খাবার সরবরাহ এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে হয়নি।
রুহুল আলম, সিলেট সিটি করপোরেশনের বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী (আশ্রয়কেন্দ্রের অতিরিক্ত দায়িত্ব)

সিলেট সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত সিলেট নগরে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে ৩০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছিল। শনিবার সকাল থেকে আশ্রয়কেন্দ্রের হিসাব রাখা সম্ভব হয়নি। যে যেদিকে পারছেন, ছুটছেন। বাসিন্দারা যেখানে উঁচু জায়গা পাচ্ছেন, সেখানে অবস্থান করছেন। এর মধ্যে নগরের বেশ কয়েকটি ভবনের নিচতলায় পানি প্রবেশ করায় অনেকে দ্বিতীয় তলায় অবস্থান করছেন। সরকারের ত্রাণসহায়তা এখনো এসব আশ্রয়কেন্দ্রে পৌঁছায়নি।

কিশোরী মোহন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মাজেদা বেগমের (৬০) বাসা নগরের যতরপুর এলাকার মজিদ মিয়ার কলোনিতে। ঘরের সাত সদস্য নিয়ে তিনি আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। ছেলে ভ্যান চালিয়ে আয়রোজগার করতেন। কিন্তু এখন বৃষ্টির মধ্যে ভ্যান চালাতে পারছেন না। মাজেদা বলেন, ছেলে আগে যা আয়রোজগার করেছেন, সেগুলো সব খরচ হয়ে গেছে। বৃষ্টি থামলে কেউ যদি কোনো সহযোগিতা নিয়ে আসেন, সে আশায় রয়েছেন তিনি।

সিলেট সিটি করপোরেশনের বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী (আশ্রয়কেন্দ্রের অতিরিক্ত দায়িত্ব) রুহুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে কতজন রয়েছে, সেটি বলা যাচ্ছে না। এখন সব কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সরকারিভাবে ৩০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পাওয়া গেছে, কিন্তু বৃষ্টির মধ্যে সেগুলোও আনা হয়নি। খাবার সরবরাহ এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে হয়নি। কিন্তু যে যেভাবে পারছেন, সহযোগিতা করছেন। এর বাইরে জনপ্রতিনিধিরাও এগিয়ে আসছেন।

গতকাল সকালে সিলেট নগরের প্রায় ২০টি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রায় সব এলাকা এবং সড়কে উঠেছে পানি। এর মধ্যে শাহজালাল উপশহর, সোবহানীঘাট, মেন্দিবাগ, নাইওরপুল, মিরাবাজার, টিলাগড়, শেখঘাট, তালতলা, মাছুদীঘির পাড়, জামতলা, মির্জাজাঙ্গাল, বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, দাড়িয়াপাড়া এলাকার সড়কে এবং বাসাবাড়িতে পানি উঠেছে। সড়কে পানির স্রোত বেশি থাকায় নাইওরপুল থেকে সোবহানীঘাটের সড়ক বন্ধ রাখা হয়েছে। বন্যার পানিতে সড়কে বেশ কয়েকটি যানবাহন অকেজো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে।

নগরের দাড়িয়াপাড়া, মির্জাজাঙ্গাল এলাকায় গতকাল বেলা ১১টার দিকে পানি বাড়তে শুরু করে। এরপর বেশ কয়েকটি বাসাবাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। এ সময় ওই এলাকার বাসিন্দাদের ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশে সড়কে দাঁড়িয়ে যানবাহনের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে।

দাড়িয়াপাড়ার বাসিন্দা ভবতোষ পাল বলেন, বাসায় পানি প্রবেশ করেছে। শুক্রবার ইট-সিমেন্ট দিয়ে বাঁধ বানিয়েছিলেন। কিন্তু গতকাল বেলা ১১টার দিকে ঝুম বৃষ্টিতে পানি ঘরের তৈরি করা বাঁধ উপচে প্রবেশ করেছে। এখন ঘরে হাঁটুসমান পানি।

সিলেট নগরের শাহজালাল উপশহর এলাকার বাসিন্দা জামিল আহমেদকে গতকাল সকালে পানি ভেঙে রিকশায় করে বাড়ি থেকে বের হতে দেখা যায়। উপশহর মোড় এলাকায় তিনি বলেন, ‘পানির মধ্যে তিন দিন ছিলাম। এখন বাধ্য হয়ে বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছি। বাসায় আর থাকার মতো অবস্থা নেই। আপাতত এক বন্ধুর বাসায় উঠব।’

নগরের কদমতলী বাসস্ট‌্যান্ডেও ছিল কোমর থেকে হাঁটুসমান পা‌নি। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা এম‌সি কলেজের শিক্ষার্থী রায়হানুল ইসলাম বলেন, ‘বা‌ড়ি থেকে মা বারবার ফোন দিচ্ছেন। শহরে পা‌নি বাড়ছে। এমন অবস্থায় কোমরপা‌নি মা‌ড়িয়ে রিকশায় পাঁচ গুণ ভাড়া দিয়ে বাস টা‌র্মিনালে এসে‌ছি। কিন্তু এর মধ্যে সব কাপড় ভিজে গেছে।’ হ‌বিগঞ্জের নবীগঞ্জ যাচ্ছেন বলে জানান তি‌নি।