রেললাইন নির্মাণের জন্য প্রতি ঘনমিটার মাটি ভরাটের কাজে সর্বোচ্চ ব্যয় হয় ৪০০ টাকা, কিন্তু চীন–বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে (জিটুজি পদ্ধতি) রেললাইন নির্মাণের দুটি প্রকল্পে ওই কাজের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৮০০ টাকার বেশি। একইভাবে রেললাইন বসানো, পাথর, স্লিপারসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম কিনতে অতিরিক্ত ব্যয় ধরে দুটি প্রকল্পের চূড়ান্ত অনুমোদনও নেওয়া হয়। তবে প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের উচ্চপর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি বাড়তি ব্যয়ের বিষয়টি চিহ্নিত করেছে। পরে দুটি প্রকল্প থেকে মোট ৪ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা কমাতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এ–সংক্রান্ত প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন গত বৃহস্পতিবার রেলপথ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছে।
চীনের সঙ্গে জিটুজি পদ্ধতির আওতায় রেলে চারটি প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে দুটি হচ্ছে আখাউড়া-সিলেট মিশ্র গেজ (একই সঙ্গে ব্রডগেজ ও মিটারগেজ, দুই ধরনের ট্রেনই চলতে পারবে) রেললাইন নির্মাণ। এর ব্যয় ১৬ হাজার ১০৪ কোটি টাকা। আর জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী মিশ্র গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয় ১৪ হাজার ২৮০ কোটি টাকা।
এর আগে গত ১৫ সেপ্টেম্বর চীনের সঙ্গে জিটুজি পদ্ধতির প্রকল্প নিয়ে ‘চড়া সুদের ঋণে উন্নয়ন, প্রকল্পে বিলাসী ব্যয়’ শিরোনামে প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর ৩০ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউসের সভাপতিত্বে রেলের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের নিয়ে এক বৈঠকে উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। কমিটির প্রধান করা হয় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তৎকালীন সচিব ফাতিমা ইয়াসমিনকে। অন্য সদস্যদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন ও রেলওয়ের প্রতিনিধি ছিলেন। কমিটি গত অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি প্রতিবেদন জমা দেয়। এর ভিত্তিতেই প্রধানমন্ত্রী প্রকল্পের ব্যয় কমানোর নির্দেশনা দেন।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে জিটুজি প্রকল্পের বিষয়ে পাঠানো অনুশাসনে বলা হয়েছে, আখাউড়া-সিলেট প্রকল্পের অনুমোদিত ব্যয় থেকে ৩ হাজার ৩৫৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা (২০ দশমিক ৮ শতাংশ) কমাতে হবে। জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী প্রকল্পে অনুমোদিত দরপত্র মূল্য থেকে ১ হাজার ৪৯৫ কোটি ৫১ লাখ (১২ দশমিক ৯১ শতাংশ) কমিয়ে প্রকল্পটি সংশোধন করতে হবে। এ ছাড়া তদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণ, সুপারিশসহ সার্বিক বিষয়ে যথাযথ পর্যালোচনা করে প্রকল্পের প্রয়োজনীয় সংশোধনসহ বিধি অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়ার কথা অনুশাসনে বলা হয়েছে।
জিটুজি পদ্ধতির আওতায় রেলের বাকি দুটি প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে পদ্মা সেতু রেল লিংক এবং জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ-জামালপুর মিশ্র গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ। এর মধ্যে পদ্মা সেতু রেল লিংক প্রকল্পের কাজ অনেকটাই এগিয়েছে। জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ-জামালপুর মিশ্র গেজ ডাবল লাইন প্রকল্পে ঠিকাদারের সঙ্গে দর–কষাকষি সম্পন্ন হয়েছে। তবে তা সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন হয়নি।
জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, চীনের সঙ্গে জিটুজি প্রকল্পের ব্যয় নিয়ে রেলের মধ্যেই আলোচনা–পর্যালোচনা চলছিল। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাও এসেছে। এখন পরবর্তী করণীয় কী হবে, সেটা নিয়ে কাজ চলছে। সব দিক বিচার–বিশ্লেষণ করেই এগোবেন তাঁরা।
চারটি জিটুজি প্রকল্পে চীনা সরকার ঋণ দিচ্ছে। জমি অধিগ্রহণসহ অন্যান্য খরচ বহন করছে বাংলাদেশ। অর্থায়নের মূল ভিত্তি হচ্ছে, উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা যাবে না। কাজ করবে চীনের একমাত্র ঠিকাদার। এটাকে বলা হচ্ছে সরাসরি ক্রয়পদ্ধতি। প্রক্রিয়াটা হচ্ছে এমন—নির্দিষ্ট ঠিকাদার ব্যয়ের প্রস্তাব দেবে। এরপর দুই পক্ষের মধ্যে দর–কষাকষি করে ব্যয় চূড়ান্ত হবে। সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন পেলে নির্মাণকাজ শুরু হবে।
ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত রেলের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে রেলের যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে, সেগুলোতে প্রতি ঘনমিটার মাটি ভরাটের কাজে সর্বোচ্চ ৪০০ টাকা ব্যয় হয়েছে। অথচ জিটুজি প্রকল্পের দর ধরা হয়েছে ৮০০ টাকার বেশি। আবার আখাউড়া-সিলেট রেললাইন নির্মাণ প্রকল্পে অস্থায়ী রেললাইন নির্মাণে ব৵য় ধরা হয়েছে ৪৮৮ কোটি টাকা। অথচ প্রকল্প শেষে এটি কোনো কাজেই লাগবে না। প্রকল্পের অধীনে সিলেটে রেলস্টেশনে ‘আইকনিক’ ভবন নির্মাণে ৩৭ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিবছর প্রায় প্রতিটি সরঞ্জামের মূল্য ২৫-৩০ শতাংশ বাড়বে ধরে নিয়ে হিসাব করা হয়েছে। ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তি সইয়ের ১৮ মাস পর থেকেই সরকারকে প্রতিটি পণ্যের এই বাড়তি মূল্য দিতে হবে। এসব কারণে প্রকল্পের ব্যয় অস্বাভাবিক ধরা হয়েছে।
রেলওয়ের তিনজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমে একদল কর্মকর্তা প্রাক্–উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়ন করেন। এরপর রেলের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত একটি কারিগরি কমিটি দর–কষাকষি করে ব্যয় নির্ধারণ করে। সেই ব্যয় চূড়ান্ত করার জন্য রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিবের নেতৃত্বে আরেকটি কমিটি রয়েছে। চূড়ান্ত পর্যায়ে সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি তা অনুমোদন দেয়। ওই কর্মকর্তারা বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের অনুমোদন পেতে বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মকর্তা, ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিক, আমলাসহ অনেককেই আর্থিক সুবিধা দিয়ে থাকেন।
দুই প্রকল্প থেকে মোট ৪ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা ব্যয় কমাতে রেলপথ মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ।
পদ্মা সেতু রেল লিংক প্রকল্পের অধীনে ঢাকার গেন্ডারিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জ-মুন্সিগঞ্জ হয়ে যশোর পর্যন্ত মূল, শাখা লাইনসহ ২১৫ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হবে। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে ২৮ হাজার ৬১১ কোটি টাকার। ২০১৬ সালের আগস্টে চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডকে এই প্রকল্পের ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুসারে, গত অক্টোবর পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ।
আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত মিটারগেজ রেললাইন মিশ্র গেজে রূপান্তরের কাজ পেয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো গ্রুপ। এ প্রকল্পের ভৌত কাজ শুরু হয়নি। গত ২৬ আগস্ট এই প্রকল্পের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি চিঠি লেখেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। ঠিকাদার নিয়োগ এবং চীনা সরকার অর্থায়ন নিশ্চিত করার পরও কাজে দেরি হওয়ার বিষয় উল্লেখ করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ জানান তিনি। চিঠিতে প্রকল্পের ব্যয় বেশি নয় বলেও দাবি করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এমনকি কাজে দেরি হলে চীনা সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক ভুল–বোঝাবুঝি সৃষ্টি হতে পারে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। গত বছর আগস্টে এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানকেও চিঠি দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
এর আগে গত বছরের আগস্ট মাসে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল থেকে নির্বাচিত প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমদ এবং পরিবেশ ও বনমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন এই প্রকল্প বাস্তবায়নে চিঠি দেন পরিকল্পনামন্ত্রীকে। তিন মন্ত্রীর চিঠি পেয়ে গত বছর অক্টোবরে পরিকল্পনামন্ত্রী চিঠি দেন রেলমন্ত্রীকে।
গাজীপুরের জয়দেবপুর-পাবনার ঈশ্বরদীর মধ্যে রেললাইন নির্মাণকাজের ঠিকাদার চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন। এখনো এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি। আর জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ হয়ে জামালপুর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের ব্যয় চূড়ান্ত হয়নি। এ কাজের ঠিকাদার চায়না রেলওয়ে ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপ।
রেলের নথি বলছে, সিলেটেরই কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথে মিশ্র গেজ লাইন নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হচ্ছে ১০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। প্রায় একই ধরনের কাজ হচ্ছে আখাউড়া-সিলেট পথেও। অথচ এই প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ৫৮ কোটি টাকার বেশি।
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হচ্ছে ৭৯ কোটি টাকার বেশি। এর কাছাকাছি ধরনের কাজ হচ্ছে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত। সেখানে মিশ্র গেজের নতুন রেললাইন নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় পড়ছে ৪৫ কোটি টাকা।
জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী মিশ্র গেজ ডাবল লাইন নির্মাণের প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হবে প্রায় ৫৯ কোটি টাকা। জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ-জামালপুর পথে ব্যয় প্রায় ৫৪ কোটি টাকা। আখাউড়া-লাকসাম পথে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় ১৯ কোটি টাকা।
রেলের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ হলে প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় অনেক কমে আসে। কিন্তু সরাসরি একজন ঠিকাদারকে কাজ দেওয়া হলে ব্যয় অনেক বেড়ে যায়।
জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, চীনা ঠিকাদারেরা সরকারি কর্মকর্তা ও প্রভাবশালীদের সুবিধা দেওয়া ও নেওয়ার কাজে খুবই সিদ্ধহস্ত। কতিপয় ব্যক্তি সুবিধা নিয়ে দেশের ওপর ঋণের বোঝা বাড়িয়ে দিচ্ছেন। চড়া সুদের এই ঋণের ভার যুগ যুগ বহন করতে হবে। শ্রীলঙ্কা তো ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে পুরো বন্দরই চীনাদের হাতে তুলে দিয়েছে। প্রতিযোগিতাহীন দরপত্রের মাধ্যমে এভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারকে আরও সতর্ক হওয়া দরকার।