‘শালগাছে ফুটেছে সারজম, মহুয়ায় ফুটেছে মাতকম’, সেই সঙ্গে বাহা উৎসবে মেতেছে সাঁওতালরা। বাহা উৎসবের মাধ্যমে প্রতিবছর ঋতুরাজ বসন্তকে বরণ না করা পর্যন্ত সাঁওতালরা মাতকমের মধু খায় না, খোঁপায় দেয় না সারজম ফুল।
প্রকৃতিতে ঋতুরাজ বসন্ত আসে হরেক রকমের ফুলের সৌন্দর্য নিয়ে। নতুন ফুল ফোটার আনন্দে আর দেবতাকে তুষ্ট করতে এ সময় সাঁওতালরাও মেতে থাকে নাচে আর গানে।
দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলা সদর থেকে মাত্র ছয় কিলোমিটার পথ শেষে দেখা মিলবে বারকোনা গ্রাম। গ্রামের ঠিক মাঝখানে কলম সরেন-আলমা সরেন মাঠ। সেই মাঠেই বাহা উৎসবে মেতেছে ১৫০টি সাঁওতাল পরিবারের লোকজন।
গত শুক্রবার সকাল আটটা থেকে গতকাল শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত দুই দিনব্যাপী সাঁওতালদের নানা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, পূজা–পার্বণের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে তাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎসব বাহা পরব-১৪২৫। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং বারকোনা মীঞ্জহি পরিষদ ও আদিবাসী সাংস্কৃতিক পরিষদের সহযোগিতায় এ উৎসব হয়।
বাহা পরবের প্রথম দিনকে বলা হয়, উম আর দ্বিতীয় দিনকে বলা হয় বাহা সীরদি। শুক্রবার সকাল থেকে কলম সরেন–আলমা সরেন মাঠের পশ্চিম কোনায় জাহের থানে গ্রামের নাইকের (পুরোহিত) উপস্থিতিতে শুরু হয় পূজা অর্চনা। নাইকের হাতে কাঁসার থালায় সিঁদুর, কলা, ধূপ আর নতুন নতুন ফুল থাকে। গোবর দিয়ে লেপন দেওয়া পূজার স্থানে বসে নানা রকম আচার ক্রিয়া করেন নাইকে।
এরপর জ্যান্ত মুরগির মাথায় সিঁদুর পরিয়ে মুখে খাবার হিসেবে তুলে দেওয়া হয় আতপ চাল, খাবার শেষে মুরগিকে বলি দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে জাহের থানের (পূজার স্থান) তিন পাশে নারীরা নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে গলায় তোলেন সাঁওতালি গান—‘অকয় মায় চিয়ালেৎ হো বির দিসম দ, মারাং বুরুয় চিয়ালেৎ হো বির দিসম দ’।
বেলা তিনটার সময় বাহা পরবের উদ্বোধন করেন দিনাজপুর-৫ আসনের সাংসদ মোস্তাফিজার রহমান। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক মাহমুদুল আলম, দিনাজপুর সরকারি কলেজের দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাসুদুল হক, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্র সরেন প্রমুখ।
বাহা পরবের দ্বিতীয় দিনে দিনাজপুর-১ আসনের সাংসদ মনোরঞ্জন শীল গোপাল ও পুলিশ সুপার সৈয়দ আবু সায়েমের উপস্থিতিতে আলোচনা অনুষ্ঠান হয়। পরে সাঁওতালি ও বাউলশিল্পী রথীন কিস্কু, ডগর টুডু, বিজলী মুরমু, রামেশ্বর মুরমু ও তাঁদের দলের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়।
দুই দিনব্যাপী সাঁওতালদের এই দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎসবে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে এবং ভারতের ওড়িশা ও আসাম থেকে আসা সাঁওতালদের উপস্থিতিতে পার্বতীপুরের বারকোনা কলম সরেন–আলমা সরেন মাঠ যেন এক মিলনমেলায় পরিণত হয়। এতে হাঁড়িয়া পানে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে গান ও নৃত্যে মেতেছিলেন সাঁওতাল নারী–পুরুষ।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্র সরেন বলেন, ‘প্রতিবছর ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এ উৎসব পালন করে সমতলে বসবাসকারী সাঁওতালরা। এই সহজ–সরল সাঁওতাল নৃগোষ্ঠীর চাওয়া–পাওয়ার তেমন কিছুই নেই। কিন্তু আমরা যেন অধিকারবঞ্চিত না হই, সে জন্য সমাজের সবাই যেন আমাদের প্রতি দৃষ্টি দেয়।’