বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যায় বিশ্বে দ্বিতীয় বাংলাদেশ

চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে ২৫ লাখ মানুষ। সবচেয়ে বেশি ভারতে।

ঘূর্ণিঝড় আম্পানে খুলনার কয়রা উপজেলার একটি বাঁধ ভেঙেছিল গত ২০ মে। এরপর পেরিয়েছে চার মাসের বেশি। বাঁধটি মেরামত হয়নি।

কয়রা উপজেলা বঙ্গোপসাগরের কাছে। বাঁধ না থাকায় উপজেলার প্রায় ১০ হাজার মানুষের ঘরবাড়ি প্রতিদিনই জোয়ারের পানিতে ডোবে, আবার ভাটায় জেগে ওঠে। বাস্তুচ্যুত হয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের একাংশ প্রায় পাঁচ মাস ধরে বাঁধ ও সড়কে বাস করছেন।

কয়রার সঙ্গে সারা দেশের বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা যোগ করলে অঙ্কটা বেশ বড়ই হবে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের (আইডিএমসি) ‘অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতি: বছরের মধ্যবর্তী চিত্র’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ২৫ লাখ ২০ হাজার মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। গত বছরের পুরো সময়ে সংখ্যাটি ছিল ৪১ লাখ ৭০ হাজার।

প্রতিবেদনটি গত ২৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত হয়। এতে উল্লেখ করা হয়, নিজ দেশের ভেতরে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত হওয়া মানুষের সংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। এক নম্বরে ভারত। পাশের দেশটিতে আলোচ্য সময়ে ২৬ লাখ ৭০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। অবশ্য এখানে মাথায় রাখা দরকার যে ভারতের জনসংখ্যা ১৩৫ কোটির বেশি। আর বাংলাদেশের ১৬ কোটি।

বছরের প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশে বাস্তুচ্যুত হওয়া ব্যক্তিদের ২৪ লাখ ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সময় সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া। আরও এক লাখ নিজ ব্যবস্থায় ঘর ছেড়ে অন্য জায়গায় আশ্রয় নেয়। আইডিএমসির প্রতিবেদনে বলা হয়, এদের বড় অংশ কিছুদিনের মধ্যেই ঘরে ফিরে যায়। তবে একটা অংশ ঘরে ফিরতে পারেনি। আরেকটি অংশকে দীর্ঘদিন নিজেদের ঘরছাড়া থাকতে হয়।

অবশ্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় বলছে, বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা কোনোভাবেই ৮ থেকে ১০ লাখের বেশি নয়। এরা দুর্যোগ শেষে আবার বাড়িতে ফিরে যায়। অবশ্য দেশে দুর্যোগ নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর মতে, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে কমপক্ষে ৪০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সামনে অক্টোবর-নভেম্বর মাস ঘূর্ণিঝড়ের আশঙ্কাও রয়েছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, যারা ঘরে ফিরতে পারে না, এমন আট লাখ মানুষের জন্য সরকার গুচ্ছগ্রাম করে দিচ্ছে। ফলে কেউ ঘরবাড়ি ছাড়া থাকবে না।

বাংলাদেশে চলতি বছরের শুরুতে অতিবৃষ্টি হয়। তারপর মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আম্পান আঘাত হানে। জুলাই থেকে শুরু হয়েছে দীর্ঘস্থায়ী বন্যা। আইডিএমসির প্রতিবেদনে বলা হয়, বছরের প্রথম ভাগের দুর্যোগ বাংলাদেশের মানুষের ফসল ও মাছের ক্ষতি করেছে। একই সময়ে করোনার সংক্রমণ মানুষের জীবিকাও নানাভাবে ক্ষতির মুখে ফেলেছে।

আইডিএমসি দুই ধরনের অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত মানুষের কথা উল্লেখ করেছে। সংঘাতের কারণে ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে। সংঘাতে সবচেয়ে বেশি বাস্তুচ্যুত হয়েছে সিরিয়া, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক কঙ্গো, বুরকিনা ফাসো, দক্ষিণ সুদান ও সোমালিয়ার মানুষ। বাংলাদেশে বছরের প্রথম ছয় মাসে ২১০ জন মানুষ সংঘাতের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। দুর্যোগে বাস্তুচ্যুতের তালিকায় ভারত ও বাংলাদেশের পরে ফিলিপাইন, চীন ও সোমালিয়া রয়েছে।

এদিকে দেশের বিভিন্ন জেলা এখন বন্যাদুর্গত। বগুড়ার প্রায় দেড় লাখ মানুষ এখনো বন্যার কারণে অন্যত্র আশ্রয়ে আছে। জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলার চরের বাসিন্দারের বাড়িঘর গত জুলাই থেকে পানিতে ডুবে রয়েছে।

বগুড়া জেলার ত্রাণ কর্মকর্তা আজহার আলী মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, চরের প্রায় দেড় লাখ মানুষ প্রতিবছর বন্যায় অন্য উঁচু স্থানে আশ্রয় নেয়। পানি নেমে গেলে আবার ফিরে যায়। এবার বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় তাদের ফিরতে দেরি হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘এদের মধ্যে প্রায় আট হাজার মানুষ স্থায়ীভাবে ঘরবাড়ি হারা হয়েছে। তাদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারের কাছে আমরা প্রস্তাব পাঠিয়েছি।’

১৬টি জেলা মারাত্মক নদীভাঙনের শিকার। এর মধ্যে একটি মাদারীপুর। গত জুলাই থেকে আগস্ট পর্যন্ত মাদারীপুরের শিবচরের বন্দরখোলা ইউনিয়নের বড় অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়। সেখানকার কাজীরসুরা বাজার পদ্মার ভাঙনের হুমকির মুখে রয়েছে, যেটি প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের জীবিকার উৎস।

দুর্যোগ এবং ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার কারণে ভেঙে যাওয়া বাঁধ যথাসময়ে মেরামত না হওয়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষকে প্রতিবছরই অন্যত্র আশ্রয় নিতে হয় বলে উল্লেখ করেন বেসরকারি সংস্থা কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাদের বড় অংশ শহরে বস্তিবাসী হয়। বস্তি থেকেও তাদের কয়েক বছর পরপর উচ্ছেদ করা হয়। তিনি আরও বলেন, এসব মানুষের জন্য গুচ্ছগ্রাম করার চেয়ে তারা যাতে নিজ এলাকায় থাকতে পারে, সেই ব্যবস্থা করা উচিত।

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি, বগুড়া, শরীয়তপুর, চাঁদপুর ও খুলনা।)