দেশে অপ্রচলিত এক খেলা রাগবি। তার ওপর মেয়েদের রাগবি দল। তবু এমন দল গড়ার স্বপ্ন নিয়ে বাগেরহাটের ফকিরহাটে বছর তিনেক আগে শুরু হয় তৎপরতা। খেলোয়াড় জোগাড় করতে বাড়ি বাড়ি ধরনা দিতে শুরু করেন উদ্যোক্তারা। আগ্রহী মেয়েদের দলে ভিড়িয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে খেলোয়াড় হিসেবে গড়ে তোলেন। শ্রম–ঘামে গড়া দলটি এ বছর জাতীয় মহিলা রাগবি প্রতিযোগিতায় অংশও নেয়। সেই দলের পাঁচজনের করোনাকালে বিয়ে হয়ে গেছে। এর মধ্যে চারটিই আবার বাল্যবিবাহ।
চারজনের মধ্যে তিনজন ফকিরহাট উপজেলার বেতাগা আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী। অপরজন বেতাগা ইউনিয়নের মাসকাটা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রী। বিয়ে হয়ে যাওয়া অপরজন স্থানীয় কলেজে উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। তাঁর বয়স সবে ১৮ বছর পেরিয়েছে। জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া বাগেরহাটের দলটির ক্যাপ্টেন ছিলেন তিনি। স্থানীয় সামাজিক-পারিবারিক বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে রাগবি দলটির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, বিয়ে হয়ে যাওয়ায় মেয়েগুলো আর রাগবি খেলতে পারবে না।
রাগবি দলটি গড়ে তুলতে কাজ করেছে স্পোর্টস ফর হোপ অ্যান্ড ইনডিপেন্ডেন্স (শি) নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ঢাকা থেকে পরিচালিত সংগঠনটি দেশের বিভিন্ন এলাকায় নানা বয়সের ছেলেমেয়ে ও প্রতিবন্ধীদের বিনা মূল্যে বিভিন্ন খেলাধুলার প্রশিক্ষণ দেয়। একই সঙ্গে এসব খেলোয়াড়কে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় যুক্ত করতেও কাজ করে তারা। বাগেরহাটে মেয়েদের রাগবি দলের পাশাপাশি ছেলেদের রাগবি দল গঠনে সহায়তা করেছে শি। ছেলেদের দলটি ২০১৯ সালে জাতীয় রাগবি লিগে অংশ নিয়ে দ্বিতীয় রানার্সআপ হয়েছিল।
শি–এর প্রতিষ্ঠাতা শারমিন ফারহানা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামের মেয়েদের রাগবি খেলায় যুক্ত করতে তাঁদের অনেক লড়াই করতে হয়েছে। সেই মেয়েদের এভাবে হারাতে হবে, তিনি ভাবতেও পারছেন না। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক।
সংগঠন সূত্র বলছে, গ্রামীণ সমাজে মেয়েদের খেলাধুলায় সম্পৃক্ততার বিষয়টি এমনিতেই কটু চোখে দেখা হয়। শি নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি কাজ শুরুর পর বাধার মুখে পড়ে। সবার প্রশ্ন ছিল, রাগবি আবার কী খেলা? আর মেয়েরাই–বা খেলবে কেন? কিছু মেয়ে আগ্রহী হলেও অভিভাবকেরা বেঁকে বসছিলেন। অনেক মা–বাবা সামাজিক সমালোচনার ভয়ে মেয়েদের রাগবি খেলতে দিতে চাইছিলেন না। কিন্তু স্থানীয় স্কুল ও ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) কর্তৃপক্ষগুলোর সহযোগিতায় তারা মেয়েদের রাগবি দল গঠনে সক্ষম হয়। ২০১৭ সালের অক্টোবর থেকে মেয়েদের রাগবির প্রশিক্ষণ শুরু হয়। মোট ৩৭ জন মেয়েকে নিয়ে দল গঠন করা হয়। তাদের মধ্যে বিয়ে হয়ে যাওয়া পাঁচটি মেয়ে বেশ দক্ষ ছিল। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও এই মেয়েরা খেলবে, এমন আশা করতে পারছে না সংগঠনটি।
বাল্যবিবাহের শিকার রাগবি খেলোয়াড়দের মধ্যে দুজন বেতাগা আদর্শ মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে পড়ে; আরেকটি মেয়ে এই বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক নিখিল চন্দ্র দাশ প্রথম আলোকে বলেন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শি তাঁদের কাছে প্রস্তাব রাখার পর তাঁরা ছাত্রীদের মা–বাবাকে ডেকে এনে স্কুলে বৈঠক করেন। অনেক বুঝিয়ে তাঁদের রাজি করানো হয়। তিনটি মেয়ে জাতীয় পর্যায়ের খেলায় অংশ নিয়েছিল। ওদের অনেক সম্ভাবনা ছিল। বিয়ের কারণে মেয়েগুলো অকালে ঝরে পড়ায় তাঁর অন্তরে অনেক দুঃখ।
দশম শ্রেণির মেয়েটি মা–বাবার সপ্তম সন্তান। ছয় ভাই, এক মেয়ের মধ্যে সে সবার ছোট। মেয়েটির বাবা নিজেও খেলোয়াড়। ছিলেন স্থানীয় ফুটবল দলের গোলরক্ষক। মেয়েটি ফুটবল, রাগবি দুটোই ভালো খেলে। তাকে নিয়ে স্বপ্নও দেখতেন বাবা। প্রথম আলোকে বললেন, ‘মেয়ের বিয়ে দিয়েছি শুনে তাঁর সঙ্গে অনেক ঝগড়া করেছেন নিখিল স্যার। অপরাধ তো, একটু কথা তো শুনতে হবে। আমার মনেও ব্যথা আছে। আইএ (এইচএসসি) পাসের পর বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। এক চক্করে পড়ে মাস দুয়েক আগে বিয়েটা হয়ে গেল। জামাই নম্র-ভদ্র। বলেছে, মেয়েকে পড়াশোনা করতে দেবে। খেলতে দেবে কি না তা নিয়ে আলোচনা করব।’
মাসকাটা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের রাগবি খেলোয়াড় মেয়েটি সবে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। গ্রামবাসী বলছেন, অভাবের কারণে মেয়েটিকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন মা। বাবা নেই। মেয়েটি মায়ের একমাত্র সন্তান। তিনি মাটি কাটার কাজ করে সংসার চালান। গত ঈদুল আজহার আগে মেয়েকে বিয়ে দেন।
মেয়েটি প্রথম আলোকে বলল, ‘মায়ের এক হাতের কামাই। ভালো ছেলে পাইল, তাই বিয়ে দিল। স্বামী কলের কাজ (মিস্ত্রি) করে। ইউনুস স্যার (প্রধান শিক্ষক) যদি বকা দেয়, এই ভয়ে মা আর স্কুলে যেতে বারণ করেছে।’ রাগবি খেলতে খুব ভালো লাগে জানিয়ে মেয়েটি এই প্রতিবেদকের কাছে প্রশ্ন রাখল, ‘স্কুলে না পড়লে কী রাগবি খেলতে পারব? আমাকে খেলায় নেবে?’
মাসকাটা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইউনুস আলী শেখ বেতাগা ইউপির চেয়ারম্যানও। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘স্কুল খোলা থাকার সময় হলে বাল্যবিবাহ ঠেকাতে পারতাম। করোনাকালে স্কুল বন্ধ। খবরও পাচ্ছি না। অভিভাবকেরা মেয়েদের এলাকার বাইরে নিয়ে গিয়েও বিয়ে দিচ্ছেন। আমরা খবর পাচ্ছি বিয়ে হওয়ার পরে।’ রাগবি দলটি নিয়ে আশা প্রকাশ করে ইউনুস আলী বললেন, ‘প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার মতো আরও ১৭-১৮ জন মেয়ে রয়েছে। আমরা তাদের নিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়াব।’
রাগবি খেলোয়াড় মেয়েদের বাল্যবিবাহের তথ্য জানা নেই ফকিরহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তানভীর রহমানের। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আগে থেকে খবর পেলে আমরা বিয়ে প্রতিরোধ করতে পারতাম। করোনাকালে অভিভাবকেরা বিয়ে নিবন্ধন না করার কৌশল নিয়ে বাল্যবিবাহ দিচ্ছেন। অভিভাবকেরা ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ না হলে বাল্যবিবাহ ঠেকানো খুব কঠিন।’