সানিয়া মির্জা, জেসমিন আক্তার, স্বপ্না আক্তার, আরজু রহমান, রাসেল ইসলাম রুমেল, আবুল কাশেম, রুবেল ও নিজাম হোসেন। এই সমাজে তাদের পরিচয় পথশিশু হিসেবে। তাদের মা–বাবা নেই, পরিবার নেই। তারা এতিম। এই আট শিশু চলতি বছরে প্রথমবারের মতো আয়োজিত স্ট্রিট চিলড্রেন ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপে খেলার জন্য নির্বাচিত হয়েছে। অভিভাবক না থাকার জন্যই নির্বাচিত হওয়ার পরও তারা খেলতে পারবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এই শিশুদের পাসপোর্ট পেতে হলে বেশ কিছু ধাপ পার হতে হয়, কিন্তু তাদের হাতে সময় খুব কম।
চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল থেকে ৮ মে পর্যন্ত লন্ডনে পথশিশুদের জন্য এ ক্রিকেট বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে। এই বিশ্বকাপে খেলার জন্য বাংলাদেশের লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (লিডো) অধীনে থাকা এই আট শিশু নির্বাচিত হয়েছে।
এই শিশুদের সেই অর্থে এখন আর পথে থাকতে হয় না। কেরানীগঞ্জের বছিলায় লিডো পিস হোমে তারা থাকা, খাওয়া, পড়াশোনা, খেলাধুলাসহ সব ধরনের সুযোগ পাচ্ছে। সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা এবং নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ হোসেন এই শিশুদের অভিভাবক। তবে অভিভাবকহীন শিশুদের পাসপোর্ট করতে হলে অভিভাবকত্ব নিতে হলে আদালতের অনুমতি লাগে। আদালতের অনুমতির পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগে। সব মিলে বেশ কিছু সময়ের প্রয়োজন। তাই এই শিশুরা ঠিক সময়ের মধ্যে পাসপোর্ট পাবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
বুধবার বছিলার ওয়াশপুরে লিডো পিস হোমে গিয়ে দেখা যায়, এই শিশুরা পড়াশোনাসহ অন্যান্য কাজের পাশাপাশি ক্রিকেট প্র্যাকটিস করছে। নিজেদের কোনো মাঠ না থাকায় পিস হোমের পাশেই স্থানীয় এক ব্যক্তি কিছু জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন এদের খেলার জন্য। এ ছাড়া আশপাশের মাঠে গিয়েও তারা প্র্যাকটিস করে। এই শিশুরা জানাল, তাদের জন্য কোনো প্রশিক্ষক নেই। বিভিন্ন প্রশিক্ষকদের অনুরোধ করলে তাঁরা এসে শিশুদের বিভিন্ন দিক শিখিয়ে যাচ্ছেন। তবে শিশুদের কণ্ঠে দৃঢ় প্রত্যয়—তারা যদি একটু ভালো করে প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ পায় এবং পাসপোর্ট জটিলতা না থাকে, তবে তারা বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনবে। একেবারে খালি হাতে ফিরবে না। আট ক্রিকেটারের মধ্যে আরজু রহমান এবার এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। স্বপ্না একাদশ শ্রেণিতে পড়ছে। অন্যরা তৃতীয় শ্রেণিসহ বিভিন্ন শ্রেণিতে পড়ছে।
২০১০ সাল থেকে লিডো পথশিশুদের পুনর্বাসনে কাজ করছে। সানিয়া মির্জা, জেসমিন, স্বপ্নাসহ আট ক্রিকেটার একসময় পথেই ছিল। এদের কারও হয়তো মা–বাবা মারা গেছেন অথবা মা বা বাবা আরেকটি বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছেন। শিশুটি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পথে নেমে এসেছে। কেউ কেউ গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে পথে আশ্রয় নেয়। এই পথেই তারা আবার নানা নির্যাতনের শিকার হতে থাকে। এই শিশুদের পুনর্বাসনে লিডোর উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা থানায় সাধারণ ডায়েরি করে এই শিশুদের হোমে নিয়ে আসেন। এখন এই শিশুরা মূলধারার স্কুলে যাচ্ছে। মার্শাল আর্ট, গান, নাচসহ বিভিন্ন কিছু শেখার সুযোগ পাচ্ছে। বড় হচ্ছে হোমের পরিচ্ছন্ন পরিবেশে।
হোমটি পরিচালিত হচ্ছে স্থানীয় ব্যক্তিসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহায়তায়। সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ হোসেন জানালেন, লন্ডনের স্ট্রিট চাইল্ড ইউনাইটেড এই বিশ্বকাপে খেলার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। আইসিসি ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপের পাশাপাশি পথশিশুদের নিয়ে এ আয়োজনের মধ্য দিয়ে পথশিশুদের প্রতি যে অবজ্ঞা, অবহেলা তা দূর করা এবং সচেতনতা তৈরির চেষ্টা চালানো হবে। এতে বাংলাদেশ, ইংল্যান্ডসহ ১০টি দেশের ৮০ জন পথশিশু (যারা একসময় পথে ছিল) অংশ নিচ্ছে। সব দেশ থেকে চারজন মেয়ে এবং চারজন ছেলে শিশুকে নির্বাচিত করা হয়েছে।
ফরহাদ হোসেন জানান, আট মাস আগে তাঁরা জানতে পারেন তাঁদের সংস্থার শিশুরা নির্বাচিত হয়েছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড থেকে অনুমোদন পাওয়া যায় গত বছরের অক্টোবর মাসে। এরপর শিশুদের পাসপোর্ট করতে গেলে জানতে পারেন বিভিন্ন ধাপ পার হওয়ার কথা। আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আদালতের কাছ থেকে অনুমোদন পেতে অনেক সময় লেগে যায়।
ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘এই শিশুরা এখন আর কোনো সংস্থার শিশু নয়। তারা খেলতে গেলে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করবে। এতে দেশের সুনাম হবে। কিন্তু শুধু পাসপোর্টের কারণে এই শিশুরা খেলতে যেতে না পারলে তা হবে চরম দুর্ভাগ্যের। আমরা প্রধানমন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্টদের প্রতি আবেদন জানাচ্ছি, যদি সম্ভব হয় বিশেষ বিবেচনায় এই শিশুদের পাসপোর্ট করার অনুমতি দিতে।’
গত ২১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক নিজাম উদ্দিন চৌধুরীর সই করা ইমিগ্রেশন অ্যান্ড পাসপোর্ট অধিদপ্তর বরাবর এক চিঠিতে এই আট শিশুর পাসপোর্ট ইস্যু করতে লিডো কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়।
ইমিগ্রেশন অ্যান্ড পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরাও এই শিশুদের ব্যাপারে সহানুভূতিশীল। আমরা শতভাগ ওদের পক্ষে আছি। লিডো কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকবার এসেছে। তবে নিয়ম হলো কোনো শিশুর মা–বাবা না থাকলে অভিভাবক হতে গেলে আদালত থেকে অনুমতি আনতে হয়। তারপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর পাসপোর্ট করতে হয়। আমরা লিডোর প্রতিনিধিদের আদালতে যেতে বলেছি। আদালত থেকে অনুমতি পেতে কত সময় লাগবে তা তো আমরা বলতে পারব না। এ ছাড়া লিডো কর্তৃপক্ষ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিশেষ অনুমোদন আনতে পারলে হয়তো কোনো কিছু করা সম্ভব। এর বাইরে আমাদের পক্ষে আর করার কিছু নেই।’
অপরাজেয় বাংলাদেশ ১৯৯৫ সাল থেকে দেশে পথশিশুদের পুনর্বাসনে কাজ করছে। এ বেসরকারি সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানু প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের সংস্থার অধীনে থাকা শিশুরা বিভিন্ন সম্মেলনে অংশ নিতে দেশের বাইরে যাচ্ছে। তাদের পাসপোর্ট করতে সমস্যা হচ্ছে না। তবে এই শিশুদের অভিভাবকত্ব নিতে হাইকোর্ট থেকে অনুমতি নিতে হয়েছে। আমরা এ অনুমতি নিয়েছি অনেক আগে। তখন বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষ করতে প্রায় চার বছর সময় লেগে গিয়েছিল। এখন কত সময় লাগে, তা জানা নেই। তবে এই আট শিশুর বিষয়টি সরকার চাইলে বিশেষভাবে বিবেচনা করতে পারে।’