বাবার আমবাগান, বিক্রেতা মেয়ে

তাহসিন বারী
তাহসিন বারী

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে শুধু ‘আম’ লিখে সার্চ দিলেই হলো—অনলাইনে আম বিক্রির পেজ বা গ্রুপগুলো হাজির হবে মুঠোফোনের পর্দায়। সরাসরি বাগান থেকে ক্রেতার দরজায় পৌঁছানোর অফার দিচ্ছে বেশির ভাগ।

দেশে গত কয়েক বছরে অনলাইনভিত্তিক আমের ব্যবসা বেড়েছে। অনলাইনে যাঁরা আমের ব্যবসা করছেন, বছর বছরই তাঁদের বিক্রির পরিমাণ কয়েক গুণ বাড়ছে। এ ছাড়া কুরিয়ার সার্ভিসগুলোতেও বেড়েছে আমের ডেলিভারি।

নাটোরের খুদে উদ্যোক্তা তাহসিন বারী অনলাইনে আম বিক্রেতাদের একজন। সে এসএসসি পরীক্ষার্থী। তবে করোনার মধ্যে পড়াশোনার চাপ নেই। তাই গত বছর ফেসবুকভিত্তিক নারী উদ্যোক্তাদের প্ল্যাটফর্ম উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরামে (উই) যুক্ত হয় সে। উদ্যোক্তাদের নানা পণ্য নিয়ে পোস্ট দেখে নিজেরও আগ্রহ জাগে কিছু করার। তার বাবার বড় আমবাগান রয়েছে। তাই আম নিয়েই পোস্ট দেয় তাহসীন। শুরুতেই ভালো সাড়া মেলে।

তাহসীন প্রথম আলোকে বলে, ‘গতবার প্রায় ৮০ হাজার টাকার আম বিক্রি করি। এ বছর এখন পর্যন্তই দেড় লাখ টাকার বেশি আম বিক্রি হয়েছে। মানুষের অনেক সাড়া পাচ্ছি।’

তাহসীনের ফলের ঝুড়ি নামে একটি ফেসবুক পেজ আছে। এএসসি পরীক্ষার্থী তাহসীন এ বছর বাবার বাগান থেকে আম কেনে। ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী সারা দেশে সে আম পাঠায়।

ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) উদ্যোগে গত বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অনলাইনে আম মেলা নামে একটি ক্যাম্পেইনের আয়োজন করে। সেখানে ১ লাখ ৫২ হাজার অর্ডার এসেছিল। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওয়াহেদ তমাল প্রথম আলোকে বলেন, অনলাইনের আমের বিক্রি অনেক বেড়েছে। যাঁদের নিজেদের বাগান আছে, তাঁরাও এখন অনলাইনে বিক্রির উদ্যোগ নিচ্ছেন। ক্রেতারাও এখন আগ্রহী হচ্ছেন।

তাহসিন অনলাইনে আম বিক্রিতে নতুন। পুরোনো অনেকেই অনলাইনে বিপুল পরিমাণে আম বিক্রি করেন। ফেসবুকে আম বিক্রির অন্যতম বড় পেজ ‘রাজশাহীর আম’। এর উদ্যোক্তা হাসান তানভীর বলেন, পারিবারিকভাবেই তাঁদের আমের ব্যবসা ছিল। আম পাঠানোর জন্য পরিচিতদের অনুরোধ রক্ষা করতে হতো। এ ছাড়া নিজেদের বাগানের আম তখন বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে বিক্রি করতে হতো। ২০১৩ সালে তিনি ফেসবুকে পেজ চালু করে আম বিক্রির উদ্যোগ নেন।

হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মধ্যসস্বত্বভোগী না রেখে আমাদের বাগান থেকেই সরাসরি আম এখন ক্রেতার কাছে চলে যায়। শুরুতে ২০১৩ সালে প্রায় ৬৫ হাজার টাকার আম বিক্রি করি। পর্যায়ক্রমে তা বাড়তে থাকে।’

হাসানদের নিজেদের বাগানে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ মণ আম হয়। এর বাইরে তিনি নিজেও অন্য বাগান আম ধরার পর কিনে নেন। গত বছর দুই হাজার মণ আম বিক্রি করেছেন। এবার আশা করছেন এর দ্বিগুণ হবে।

হাসান তানভীরের পেজ ছাড়াও মুঠোফোন অ্যাপ ও ওয়েবসাইট রয়েছে। ক্রেতার বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের বিষয়ে বলেন, ‘বাগানের আমের ছবি নিয়মিত পোস্ট করি। লাইভ করি। এ ছাড়া ফেসবুকে পেজের একটি গ্রুপও রয়েছে। যেখানে ক্রেতারাও নিজেদের মতামত জানান।’

রাজশাহী অঞ্চলের আম ২০ মে থেকে আম পাড়া শুরু হয়েছে। বিক্রেতারা জানান, গোপালভোগ, হিমসাগর, ক্ষীরশাপাতি, ল্যাংড়া, ফজলি, আম্রপালি বেশি অর্ডার হয়। এখন হিমসাগর বেশি যাচ্ছে। পেজ ভেদে ন্যূনতম ১০ কেজি থেকে অর্ডার নেওয়া হয়। অর্ডারের এক থেকে তিন দিনের মধ্যে ক্রেতা আম পেয়ে যান।

বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই পরিচিতজনদের কাছে আম বিক্রি করতেন রাহিনুল ইসলাম। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন। গত বছর রাজশাহী ম্যাংগো পয়েন্ট নামে ফেসবুক পেজ চালু করেন। পেজ ছাড়াও বিভিন্ন ই-কমার্সভিত্তিক গ্রুপের মাধ্যমে আম বিক্রি করেন রাহিনুল। তিনি জানান, গত বছর তাঁর ৫০ মণ আম বিক্রি হয়। এ বছর এখন পর্যন্ত ২০০ মণের অর্ডার পেয়েছেন। সামনে আরও অর্ডার পাবেন বলে আশা করছেন।

কুরিয়ার সার্ভিসেও আমের ডেলিভারি বেড়েছে। সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের উপপরিচালক মো. ফজলে হক প্রথম আলোকে বলেন, গত কয়েক বছর থেকেই আমের পার্সেলের পরিমাণ বেড়েছে। সুন্দরবনের মাধ্যমে ভরা মৌসুমে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০টি আমের গাড়ি তাদের কাছে আসে।

অনলাইনে নিয়মিত আম কেনেন জাকিয়া আকতার। এ বছরও একটি পেজ থেকে হিমসাগর অর্ডার দেন। তিনি বলেন, আগেও কিনেছেন। অভিজ্ঞতা ভালো বলেই অনলাইনে অর্ডার দেন। তবে বিরূপ অভিজ্ঞতাও হয় অনেকের। যে আম অর্ডার দেন তা পান না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঠিকমতো না পাকা বা পচে যাওয়ার অভিজ্ঞতাও আছে।

অবশ্য প্রতিষ্ঠিত পেজগুলো ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা করে সুনামহানি করতে চায় না।