বাধা ঠেলে আনিলা এখন বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিতে

সেরিব্রাল পালসি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন আনিলা এখন কাজ করছেন বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিতে।
ছবি সংগৃহীত

২১ বছরের তরুণী আফিয়া কবীর আনিলা। তিনি সেরিব্রাল পালসি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন একজন ব্যক্তি। সেরিব্রাল পালসি বা মস্তিষ্কে পক্ষাঘাতের কারণে জীবনে এ পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি ধাপে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন। তবে দমে যাননি তিনি বা তাঁর পরিবার। ১ নভেম্বর থেকে আনিলা একজন কর্মজীবী নারী। জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামে (বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি) ভলান্টিয়ার অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে যোগ দিয়েছেন।

দুর্যোগকালীন সহায়তা, প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করা, খাদ্য নিরাপত্তা ইত্যাদি কাজে সংশ্লিষ্ট থেকে প্রতিবন্ধীবান্ধব পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করবেন আনিলা। আনিলা আপাতত বাসা থেকেই তাঁর দায়িত্ব পালন করছেন।

আনিলা বর্তমানে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে তৃতীয় সেমিস্টারে পড়ছেন। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামে তিনি প্রাথমিক অবস্থায় ছয় মাসের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন। অনলাইনে মিটিং করার পর আনিলার কথাগুলো কাউকে লিখে নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়েও আনিলার সঙ্গে সার্বক্ষণিক একজন সহায়তাকারী থাকেন।

আনিলা সব সময়ই চেয়েছেন তাঁর মতো প্রতিবন্ধকতার শিকার শিশু ও ব্যক্তিদের অধিকার আদায়ে কাজ করতে। সম্প্রতি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোটা সংরক্ষণ ও নিয়ম শিথিল করতে আনিলার একক আবেদন ও প্রচেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এ বিষয়ে দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে চিঠি দিয়েছে।

জন্মের পরপরই আনিলার শারীরিক সমস্যার বিষয়টি জানতে পারেন আনিলার বাবা ও মা। সঙ্গী হয় হুইলচেয়ার। আনিলা দুই হাত ও দুই পা দিয়ে কিছু করতে পারেন না। হুইলচেয়ার কেউ টেনে না নিলে তিনি নড়তেও পারেন না। কথা বলতেও অনেক কষ্ট হয়। সব কাজেই আনিলার মা সাহায্য করেন। আনিলার বুদ্ধিমত্তা সব প্রতিবন্ধকতাকে ম্লান করে দিয়েছে। হুইলচেয়ারে জীবনের গণ্ডি আটকে যাওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি আনিলার।

নতুন চাকরি প্রসঙ্গে মুঠোফোনে আনিলা বলেন, পড়াশোনা ও চাকরি—দুটো একসঙ্গে চলছে। মাত্র তো চাকরি শুরু হলো, তাই তিনি সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন।

আনিলার বাবা আশফাক-উল কবীর চাকরি ছেড়ে মেয়েকে সময় দেওয়ার পাশাপাশি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেন ও তরী ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং এ প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। মা মারুফা হোসেন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠান দুটোতে পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের নিয়ে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে সরকারের কাছ থেকে পেয়েছেন বিশেষ সম্মাননা। আর আনিলা তরী ফাউন্ডেশনে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

সেরিব্রাল পালসি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন আনিলা এখন কাজ করছেন বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিতে।

মারুফা হোসেন বলেন, ‘মেয়েকে নিয়ে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে, সামনেও সংগ্রাম করতে হবে। তবে এর মধ্যেও কিছু বিষয়ের অগ্রগতি হয়েছে। আনিলার নিজের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে। টিপসই দিয়েই আনিলা ব্যাংক এশিয়া থেকে টাকা তুলতে পারবেন। অনেকেই ভাবেন, আনিলার মতো মানুষেরা হয়তো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে না।

জীবনের প্রায় প্রতিটি ধাপে কষ্ট করতে হয়েছে আনিলাকে। স্কুলে ভর্তি থেকে শুরু করে পদে পদে বিড়ম্বনা আর মন খারাপের গল্প। কমার্সে পড়া অবস্থায় তাঁর শ্রুতলেখক দেওয়া হয় বিজ্ঞান বিভাগে পড়ে এমন একজনকে। অ্যাকাউন্টিং প্রিয় বিষয় থাকলেও তা তালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন। বিজ্ঞান নিয়েও পড়তে পারেননি। র‌্যাম্পের অভাবে বা রাস্তায় গর্ত থাকলে হুইলচেয়ার নিয়ে পড়তে হয় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। চারপাশের গণ্ডিটা ছোট হয়ে এসেছে বারবার। কিন্তু আনিলা বা তাঁর মা–বাবা হাল ছাড়েননি।

সেরিব্রাল পালসি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন আনিলা এখন কাজ করছেন বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিতে।

আনিলা শিশু বয়স থেকেই সেভ দ্য চিলড্রেনের ন্যাশনাল চিলড্রেন প্যানেলের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে হন গ্লোবাল চিলড্রেন প্যানেলের সদস্য। ২০১১ সালে লন্ডনে এ প্যানেলের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের শিশুদের প্রতিনিধিত্ব করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে নিয়েছেন ‘সুবর্ণ নাগরিক’-এর কার্ড। আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মূল বক্তা হিসেবে বক্তব্য দিয়েছেন আনিলা।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, সমাজসেবা অধিদপ্তরের বর্ষপঞ্জি, বুকলেটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আনিলার তোলা ছবি জায়গা করে নিয়েছে।

আনিলার বাবা ও মায়ের ফেসবুকের ওয়ালভর্তি তিনজনের হাসিমুখ আর সমুদ্র থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর ছবি। আনিলা যুক্তরাজ্য, ভারত, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভুটান, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশ ঘুরেছেন।