বাদ পড়া ৪৭০০ বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম আবার যুক্ত

ভাতা পাওয়া সব বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম গত অক্টোবরে একটি সফটওয়্যারে (এমআইএস) তোলা হয়। জাতীয় পরিচয়পত্রসহ অন্যান্য তথ্য যাচাই করে ভাতা পাওয়া ১ লাখ ৯২ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম সফটওয়্যারে যুক্ত করার পর সংখ্যাটি ১ লাখ ৭১ হাজার হয়ে যায়। অবহেলা বা করণিক ভুলের কারণে বাদ পড়া ২১ হাজার জনের মধ্যে ৪ হাজার ৭০০ জনের নাম আবার সফটওয়্যারে যুক্ত করা হয়েছে। সংখ্যাটি আরও বাড়বে বলে মনে করছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

অবশ্য এখনো এমআইএসে যুক্ত হয়নি আরও প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার মুক্তিযোদ্ধাদের নাম।

যাঁদের নাম বাদ পড়েছিল, তাঁদের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে আবেদন করার সময় বেঁধে দেয় মন্ত্রণালয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত তিন কর্মকর্তা জানান, আগে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে পাঠানো তালিকার ভিত্তিতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামে মাসিক ভাতা পাঠানো হতো। কিন্তু গত অক্টোবর ও নভেম্বরের ভাতা পাঠাতে গিয়ে দেখা যায়, ২১ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম এমআইএসে নেই। ওই তালিকা প্রকাশের পর অনেকেই মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ নিয়ে আসেন।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেকেই কাগজপত্র সঠিকভাবে জমা দেননি, মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারাও তা ঠিকমতো দেখেননি। এ জন্য আমরা গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। অনেকের নাম এখনো যুক্ত হয়নি। ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় আছে। এরপর বোঝা যাবে বাদ পড়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কতজন যুক্ত হলেন।’

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, যাঁদের নাম বাদ পড়েছে, তাঁদের কারও কারও সনদ জাল বা তথ্য ত্রুটিপূর্ণ। তবে করণিক ভুলের কারণে যাঁদের নাম বাদ পড়েছে, এমআইএসে নাম অন্তর্ভুক্ত করা বা তথ্য সংশোধনের জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা ও উপজেলার সমাজসেবা কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে বলে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান। এখন থেকে এমআইএসের তথ্যের ভিত্তিতেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা, পরিচিতি নম্বর, ডিজিটাল সনদ, স্মার্ট আইডি কার্ড দেওয়াসহ বিভিন্ন কল্যাণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ফলে সব বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম এমআইএসে অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। এমআইএসে থাকা তালিকা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যেকোনো তথ্য, ছবি সেখানে দেখা যাবে।

মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ইতিমধ্যে অধিকাংশ বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম এমআইএসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে তাঁরা গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে এমআইএসে এ অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। এখন থেকে এমআইএসের তথ্যের ভিত্তিতেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা, পরিচিতি নম্বর, ডিজিটাল সনদ, স্মার্ট আইডি কার্ড দেওয়াসহ বিভিন্ন কল্যাণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

৩৩ প্রমাণের একটিতে নাম থাকতেই হবে

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা ৩৩ প্রমাণের যেকোনো একটিতে নাম থাকলে এমআইএসে নাম অন্তর্ভুক্ত করা যাবে। বীর মুক্তিযোদ্ধার একাধিক প্রমাণে নাম থাকলে সব প্রচারপত্রের তথ্য তাঁর নামের বিপরীতে অন্তর্ভুক্ত থাকবে। প্রমাণের তালিকার মধ্যে রয়েছে মুজিবনগর সরকারের রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীদের তালিকা এবং মুজিবনগর কর্মচারী তালিকা। ভারতীয় তালিকার মধ্যে রয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় তালিকা, মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় তালিকা (পদ্মা), মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় তালিকা (মেঘনা), মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় তালিকা (সেক্টর) এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় তালিকা (সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী)। (লাল মুক্তিবার্তার মধ্যে) লাল মুক্তিবার্তা স্মরণীয় যারা বরণীয় যারা এবং লাল মুক্তিবার্তা (চূড়ান্ত লাল বই), খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। বাহিনী গেজেটের মধ্যে সশস্ত্র বাহিনীর শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা (সেনা, নৌ ও বিমান), শহিদ বিজিবি মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, শহিদ পুলিশ বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা।

এ ছাড়া যুদ্ধাহত সেনা মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা, যুদ্ধাহত পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ), যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের নামেয় তালিকা (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ), সেনা মুক্তিযোদ্ধাদের নামেয় তালিকা, বিমানবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, নৌবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, নৌ কমান্ডোদের তালিকা, বাংলাদেশ রাইফেলসের (বর্তমান বিজিবি) মুক্তিযোদ্ধাদের নামের তালিকা, পুলিশ বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা এবং আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। অন্যান্য গেজেটের মধ্যে রয়েছে শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের (বেসামরিক) নামের তালিকা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, বেসামরিক গেজেট, প্রবাসে বিশ্ব জনমত গেজেট, ধারণাগত জ্যেষ্ঠতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের তালিকা, বিসিএস গেজেট, শব্দসৈনিক-স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও কলাকুশলীদের তালিকা, মুক্তিযোদ্ধাদের (বীরাঙ্গনা) তালিকা, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়বৃন্দের নামের তালিকা, ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন, বিশেষ গেরিলা বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা এবং বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতালে নিয়োজিত বা দায়িত্ব পালনকারী মুক্তিযোদ্ধা গেজেট।

গত নভেম্বরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেছিলেন, জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যের ভুল বা এমআইএসে নাম তোলার ক্ষেত্রে করণিক ভুলের কারণে বড়জোর এক হাজার জন বাদ পড়তে পারেন। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে প্রায় পাঁচ হাজার নাম বাদ পড়েছে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে না দেখার কারণে।

২০১৯ সালের জুলাই মাস থেকে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসিক ১২ হাজার টাকা ভাতা পাচ্ছেন। এর আগে ছিল ১০ হাজার টাকা। এর মধ্যে দুই ঈদে ১০ হাজার টাকা করে ২০ হাজার টাকা, ৫ হাজার টাকা বিজয় দিবসের ভাতা এবং ২ হাজার টাকা বাংলা নববর্ষ ভাতা পান বীর মুক্তিযোদ্ধা। বছরে একজন সব মিলিয়ে ভাতা পান ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি বারবারই বলছি মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিতে। মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা যদি সঠিকভাবে এ তথ্য সবার কাছে পৌঁছে দিতেন, তবে এই সমস্যা হতো না।’