চূড়ান্ত করা হবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিষয়টি।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ২৬ ও ২৭ মার্চ বাংলাদেশ সফরে আসার কথা রয়েছে। মূলত তাঁর এ সফর চূড়ান্ত করতে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর আজ বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকায় আসছেন। এক দিনের এ সফরে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। এর আগে দুপুরে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নেবেন।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গতকাল বুধবার এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর ভার্চ্যুয়াল বৈঠকের পর জয়শঙ্কর ঢাকা সফর করছেন। এ সফরে তিনি দুই দেশের সম্পর্ক পর্যালোচনার সুযোগ পাবেন।
এর আগে ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে প্রথমবার ঢাকা সফর করেন এস জয়শঙ্কর। আর গত বছরের আগস্টে অনেকটা আকস্মিকভাবে ঢাকা সফর করে যান দেশটির পররাষ্ট্রসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা। এ বছরে জানুয়ারিতে দিল্লি সফর করেন বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন।
জয়শঙ্করের সফরের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন প্রথম আলোকে বলেন, দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য আরও সম্প্রসারণ, যাত্রীবাহী ট্রেন চালুসহ কানেক্টিভিটি (সংযুক্তি) বাড়ানোর বিষয়গুলো বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তোলা হবে। তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, সীমান্ত হত্যা বন্ধের বিষয়টিও আলোচনায় আসবে। এসবের পাশাপাশি ঋণ চুক্তির প্রকল্প, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র দ্রুত বাস্তবায়ন নিয়ে কথা হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে নরেন্দ্র মোদির ২৬ মার্চ ঢাকায় আসার কথা রয়েছে। সফরের প্রথম দিন সন্ধ্যায় তিনি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেবেন। পরদিন ২৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে গিয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। এরপর দুপুরে ঢাকায় ফিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় অংশ নেবেন নরেন্দ্র মোদি।
# বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনের অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর।# ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ভার্চ্যুয়াল বৈঠক করেন।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সঙ্গে দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের টানাপোড়েনে ঝুলে আছে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি। চলতি মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু হতে যাওয়া পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের কারণে অভিন্ন নদীর পানিবণ্টনের চুক্তি অনিশ্চিতই থেকে যাচ্ছে। এরপরও তিস্তার প্রসঙ্গটি জয়শঙ্করের সঙ্গে আলোচনায় তোলা হবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) মন্ত্রী পর্যায়ের শেষ বৈঠক ২০১০ সালের পর আর হচ্ছে না। তাই জেআরসির বৈঠকটি যাতে দ্রুত আয়োজন করা যায়, সে বিষয়টিতে বাংলাদেশ জোর দেবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, তিস্তার পানি চুক্তি সই অনিশ্চিত হলেও দুই দেশ ২০১৯ সাল থেকে মনু, মুহুরী, দুধকুমার, গোমতী, খোয়াই ও ধরলা নদীর পানিবণ্টনে অন্তর্বর্তীকালীন খসড়া চুক্তি নিয়ে কাজ করছে। অন্যদিকে কুশিয়ারা নদীর পানি সেচকাজে ব্যবহারের জন্য সিলেটের জকিগঞ্জে রহিমপুর খাল খননে ভারত আপত্তি করছে। এ বিষয়গুলোও নিষ্পত্তির জন্য বাংলাদেশ আলোচনায় তুলবে।
ভারতের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি বাড়লেও পাটসহ বিভিন্ন পণ্যের ওপর শুল্ক ও অশুল্ক বাধাগুলো দূর না হওয়ায় সমস্যায় পড়ছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। ভারতের আরোপিত অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক প্রত্যাহারের জন্য অনেক দিন ধরেই আলোচনা চলছে। এ ছাড়া স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য পাঠানো নিয়ে যে জটিলতা দেখা দিয়েছে, তা দূর করতে এবার আলোচনা হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি সইয়ের লক্ষ্যে একটি যৌথ সমীক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। ওই সমীক্ষা দ্রুত শেষ করার বিষয়ে তাগিদ দেবে বাংলাদেশ।
শান্তিপূর্ণ সীমান্ত প্রতিষ্ঠা
সীমান্ত হত্যাকাণ্ড নিবিড় সম্পর্কের প্রতিফলন নয়—এমন আলোচনা দুই দেশেই রয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে ভারতের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হলেও সীমান্ত হত্যা বন্ধ করা যায়নি। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) তথ্য অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি মাসেও সীমান্তে হত্যা-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন পাঁচজন। এর মধ্যে একজনকে হত্যা করা হয়েছে।
জয়শঙ্কের সঙ্গে আলোচনায় এ বিষয়টি বাংলাদেশ তুলবে। বাংলাদেশের কর্মকর্তারা মনে করেন, দুই দেশের বিস্তীর্ণ সীমান্তে যেকোনো ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে শান্তিপূর্ণ সীমান্ত প্রতিষ্ঠা করতে হলে বাংলাদেশ ও ভারতের একসঙ্গে কাজ করার বিকল্প নেই। এর জন্য সচেতনতা দরকার এবং সীমান্তে বৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।
সড়ক, রেলসহ এ অঞ্চলের সংযুক্তির কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করছে বাংলাদেশ। ভৌগোলিকভাবে দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে থাকার কারণে বাংলাদেশের সুবিধাজনক অবস্থান রয়েছে। তাই সংযুক্তির কেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হতে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার পাশাপাশি উপ–আঞ্চলিক এবং আঞ্চলিক উপায়ে যুক্ত হতে চায় বাংলাদেশ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ডের ত্রিদেশীয় মহাসড়কে যুক্ত হতে চায় বাংলাদেশ। এ বিষয়ে ঢাকার প্রস্তাব নিয়েও দুই পক্ষ আলোচনা করবে। পাশাপাশি নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে ভারতের মধ্য দিয়ে যোগাযোগের জন্য পাঁচটি নতুন রুটের প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ, যা ভারতের বিবেচনাধীন আছে।