বাঙালির শোকের দিন

আজ ১৫ আগস্ট। জাতির যে শ্রেষ্ঠ সন্তান স্বাধীনতা এনে দিয়ে বাঙালির মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন, তাঁকেই এই দিনে সপরিবার হত্যা করে জাতিকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে।

আজ শনিবার জাতীয় শোক দিবস। আজকের সূর্যোদয় হবে সেই মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করে।

আগামী বছর বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবার্ষিকী। এ উপলক্ষে এক বছরব্যাপী ‘মুজিব বর্ষ’ পালন করা হচ্ছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে কর্মসূচি কাটছাঁট করা হয়েছে। শোক দিবসের কর্মসূচিও যতটা সম্ভব ঘরে, সীমিত পরিসরে পালন করা হবে। আওয়ামী লীগ অনলাইনে আলোচনাসহ নানা কর্মসূচি নিয়েছে। সরকার ও নানা সংগঠন স্বাস্থ্যবিধি মেনে কর্মসূচি পালন করবে।

ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে সীমিত মানুষের উপস্থিতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর কবরে এবং বনানী কবরস্থানে ওই দিন নিহত বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অন্য সদস্যদের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন, দোয়া, মিলাদসহ নানা কর্মসূচি পালন করা হবে।

শুক্রবার বিকেল থেকেই রাজধানী ঢাকার অলিগলিতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের রেকর্ড করা ভাষণ প্রচার করতে শোনা যাচ্ছে। বাজছে ‘যদি রাত পোহালেই শোনা যেত, বঙ্গবন্ধু মরে নাই’সহ নানা গান।

দিবসটি উপলক্ষে বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশন বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে। এ ছাড়া জাতীয় দৈনিক ও সাময়িকীগুলো ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে। জাতীয় শোক দিবসের তাৎপর্য উল্লেখ করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের মাধ্যমে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ সব মুঠোফোন গ্রাহককে খুদে বার্তা পাঠাবে।

বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও সংস্থা জাতীয় শোক দিবসের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজ নিজ কর্মসূচি প্রণয়ন করেছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সামাজিক দূরত্ব মেনে অনুষ্ঠান পালন করার প্রস্তুতি নিয়েছে। বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোয় জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখাসহ নানা কর্মসূচি পালন করবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ১৫ আগস্টের শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় এক লাখবার পবিত্র কোরআন খতমের উদ্যোগ নিয়েছে সরকারি শিশু পরিবার এবং বেসরকারি এতিমখানার শিশুরা। এর মধ্যে ৫০ হাজারবার কোরআন খতম করেছে তারা। এতে অংশ নিয়েছে প্রায় ৭১ হাজার শিশু।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড
১৯৭৫ সালের কালরাতে বাঙালি জাতির ইতিহাসে কলঙ্ক লেপন করেছিল সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য। তাদের বুলেটে সেদিন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ঐতিহাসিক ভবনের সিঁড়িতে পড়ে ছিল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির নিথর দেহ।

সেদিন ঘাতকেরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি। তাদের হাতে একে একে প্রাণ হারিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল।

পৃথিবীর এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ, মেয়ে বেবি ও সুকান্তবাবু, বঙ্গবন্ধুর ভাগনে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি, তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি এবং আবদুল নাঈম খান রিন্টু ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও ঘনিষ্ঠজন।

ওই সময় দেশের বাইরে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর ছোট বোন শেখ রেহানা।

স্বাধীন দেশে কোনো বাঙালি তাঁর নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে না—এমন দৃঢ়বিশ্বাস ছিল বঙ্গবন্ধুর। সে জন্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতির সরকারি বাসভবনের পরিবর্তে থাকতেন তাঁর প্রিয় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর নিজ বাসভবনে। বাঙালির স্বাধিকার-স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার এ বাড়িটি অসম্ভব প্রিয় ছিল বঙ্গবন্ধুর। এখানে থেকেই বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে সর্বশক্তি নিয়ে ব্রতী ছিলেন। সেদিন ঘাতকদের মেশিনগানের মুখেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন অকুতোভয়। প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?’ কিন্তু ঘাতকের হাত তাতে কাঁপেনি।

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার পর দীর্ঘদিন বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশ ছিল তিমিরাচ্ছন্ন। সামরিক স্বৈরশাসন, ক্যু–পাল্টা ক্যু—এভাবে কাটে ১৫ বছর। এ সময় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে হত্যাকারীদের বিচারের পথ রুদ্ধ করা হয়। এমনকি খুনিদের দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়। ’৯০–এর গণ–অভ্যুত্থানে গণতন্ত্র ফেরে দেশে। জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসেন। শুরু হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার।

নানা চড়াই–উতরাই পেরিয়ে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি পাঁচ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করে জাতিকে দায়মুক্ত করা হয়। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদকে গত ৬ এপ্রিল ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১১ এপ্রিল রাতে তাঁর ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। আরও পাঁচজন আসামি এখনো পলাতক আছে।

বাণী
শোক দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাণীতে স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এবং উন্নয়ন ও গণতন্ত্রবিরোধী চক্রের যেকোনো অপতৎপরতা ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করার জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ঘাতক চক্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও তাঁর স্বপ্ন ও আদর্শের মৃত্যু ঘটাতে পারেনি।

আ.লীগের কর্মসূচি
আগস্টের শুরু থেকেই আওয়ামী লীগ নানা কর্মসূচি পালন করছে। আজ সূর্যোদয়ের ক্ষণে বঙ্গবন্ধু ভবন এবং দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশে সংগঠনের সর্বস্তরের কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিত ও কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে।

সকাল আটটায় ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হবে। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ, সহযোগী সংগঠন, মহানগরের প্রতিটি শাখার নেতা–কর্মীরা যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন।

সকাল পৌনে নয়টায় বনানী কবরস্থানে ১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, কবর জিয়ারত, ফাতেহা পাঠ, মোনাজাত ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।

সকাল ১০টায় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন, ফাতেহা পাঠ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এতে আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধিদল, গোপালগঞ্জ জেলা ও টুঙ্গিপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা উপস্থিত থাকবেন।

বাদ জোহর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সব মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। মন্দির, প্যাগোডা, গির্জা, উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।

দুপুরে অসচ্ছল, এতিম ও দুস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ করা হবে। বাদ আসর মহিলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।

১৬ আগস্ট বিকেল চারটায় শোক দিবস উপল‌ক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভা। এর বাইরে অনলাইনে বেশ কিছু আলোচনা সভা হয়েছে, আজও হবে।