সময়, সুযোগ আর পরিবেশ মিলে যোগ-বিয়োগ ঘটে অনেক ঐতিহ্যের। কিছু ঐতিহ্যের শিকড় এত গভীরে যে আধুনিকতার শত ঝাঁপটায়ও টিকে থাকে প্রাচীন বটবৃক্ষের মতো। বাঙালি চির ঐতিহ্য এই হালখাতা। সমাজের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী এই উৎসব পালনে আড়ম্বরতায় ভাটা পড়েছে বটে, তবে তা টিকে আছে স্বমহিমায়। বাংলা নববর্ষে অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হিসেবেই আসে ‘হালখাতা’।
বাংলা সন চালু হওয়ার পর নববর্ষ উদযাপনে নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে হালখাতা দ্বিতীয় বৃহৎ অনুষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দেনাদার ও পাওনাদারের মধ্যে বিশ্বাস, আস্থা ও গভীর সম্পর্কের প্রকাশ ঘটত হালখাতার মাধ্যমে। এটা ছিল সৌজন্য প্রকাশের এক ঐতিহ্য। চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সব বকেয়া পরিশোধ করা এবং পরবর্তী দিন পয়লা বৈশাখে ভূমির মালিক ও ব্যবসায়ীরা তাঁদের প্রজা ও পণ্য ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করিয়ে নতুন বছরের হিসাব শুরু করতেন। তবে রং ফিকে হয়ে এলেও পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী মহলে এখনো রয়েছে হালখাতার চল।
হালখাতার বর্তমান হাল
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলা সন চালু হওয়ার পর নববর্ষ উদ্যাপনে নানা আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। পয়লা বৈশাখের দ্বিতীয় বৃহৎ অনুষ্ঠান ছিল ‘হালখাতা’। অনুষ্ঠানটি করতেন ব্যবসায়ীরা। কৃষিভিত্তিক সমাজ ফসল বিক্রি করে হাতে নগদ পয়সা পেত। পাট ছিল নগদ পয়সার উৎস। ফসলের মৌসুমে ফসল বিক্রির টাকা হাতে না এলে কৃষকসহ প্রায় কেউই নগদ টাকার মুখ খুব একটা দেখতে পেতেন না। ফলে সারা বছর বাকিতে জিনিসপত্র না কিনে তাদের কোনো উপায় ছিল না।
পয়লা বৈশাখের হালখাতা অনুষ্ঠানে তাঁরা দোকানিদের বাকির টাকা মিটিয়ে দিতেন। অনেকে আংশিক পরিশোধ করেও নতুন বছরের খাতা খুলতেন। তারা পণ্য বাকিতে বিক্রি করতেন। সবাই সবাইকে চিনতেন বলে বাকি দেওয়ার বিষয়ে দ্বিধা থাকত না। টাকা কেউ মেরে দেবে না বলেই বিশ্বাস করতেন তাঁরা।
এর আগে পয়লা বৈশাখে নবাব ও জমিদারেরা ‘পুণ্যাহ’ উৎসব পালন করতেন বলে জানান শামসুজ্জামান খান। তিনি বলেন, এর মূল উদ্দেশ্য ছিল খাজনা আদায়। মুর্শিদাবাদের নবাবদের পাশাপাশি বাংলার জমিদারেরাও এ অনুষ্ঠান করতেন। প্রজারা ওই দিন এসে খাজনা মিটিয়ে দিতেন এবং মিষ্টিমুখ করে যেতেন।
শামসুজ্জামান খান বলেন, এখন মানুষের হাতে নগদ অর্থের অভাব নেই। এখন আর আগের মতো পরিস্থিতি নেই। সমাজের বিশাল বিবর্তন ঘটেছে। গ্রাম-বাংলার জনজীবনেও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। কেউ কাউকে চেনেন না। কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে সরে গিয়ে নগরভিত্তিক সমাজ গড়ে উঠেছে, শিল্প বিকশিত হচ্ছে। সবার হাতে কম-বেশি নগদ অর্থ আছে এখন। তাই হালখাতা পালনের ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।
ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিচর্চার প্রতিষ্ঠান ‘ঢাকা কেন্দ্র’ এর পরিচালক পুরান ঢাকা বিশেষজ্ঞ আজিম বখ্শ ষাট-সত্তর দশকে তাঁর তরুণ বয়সে দেখা হালখাতার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা মূলত ব্যবসায়ীদের অনুষ্ঠান। পুরান ঢাকায় হিন্দু ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে পাইকারি ব্যবসায়ীদের মধ্যে বেশ আড়ম্বরে হালখাতা করার প্রবণতা ছিল। এটা বেশ ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পালন করা হতো। সারা বছরের লেনদেনের পর পয়লা বৈশাখে হিসাবের খাতাটি হালনাগাদ করা হতো। সেটি ছিল লাল সালু কাপড়ের মলাটে মোড়ানো লাল রঙের একটি খাতা। দুই-তিন ভাঁজ দিয়ে ফিতা দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। সেই খাতায় পুরোনো হিসাব চুকিয়ে নতুন হিসাব খোলা হতো। যাঁরা বাকিতে পণ্য নিয়েছিলেন, তাঁরা সেই দিন দল বেঁধে এসে বাকি পরিশোধ করতেন এবং নতুন বছরের জন্য অগ্রিম অর্থ দিয়ে যেতেন।’
আজিম বখ্শ বলেন, ‘আমি দেখেছি, হিন্দু ব্যবসায়ীরা পুরোনো খাতা বাদ দিয়ে পয়লা বৈশাখে হালখাতা শুরুর আগে নতুন খাতাটি নিয়ে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে যেতেন। পূজা দিতেন। পূজারিরা সিঁদুরের মধ্যে কাঁচা পয়সা ডুবিয়ে সেই পয়সা সিলমোহরের মতো ব্যবহার করে নতুন খাতায় ছাপ মেরে তা উদ্বোধন করতেন। পয়সাকে লক্ষ্মী হিসেবে বিবেচনা করে ব্যবসায় লাভবান হওয়ার আশায় এই আচার পালন করতেন তাঁরা। পুরান ঢাকায় মুসলিম ব্যবসায়ীদের আধিক্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই উৎসব ফিকে হওয়া শুরু করে।
আজিম বখ্শ আরও বলেন, পুরান ঢাকায় এখন বনেদি ব্যবসায়ী নেই বললেই চলে। শহরের বিস্তারের সঙ্গে এই ঐতিহ্য রং হারাতে শুরু করেছে। তবে এখনো স্বর্ণকারের মধ্যে হালখাতা করার প্রবণতা রয়ে গেছে। ছোটখাটো করে হলেও তাঁরা হালখাতার ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। শাঁখারীবাজার, তাঁতিবাজার, ফরাশগঞ্জ, বাদামতলী, ইমামগঞ্জ, চকবাজারে ব্যবসায়ীরা ছোট পরিসরে হলেও হালখাতা করেন। বড় স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ এটা অনুসরণ করে চলেছেন।
যেভাবে হালখাতা
বাংলা নববর্ষ নিয়ে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের প্রবন্ধ, মোবারক হোসেনের সম্পাদনায় বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে উৎসব, নববর্ষ’, সাদ উর রহমানের ‘উৎসবের ঢাকা’ বই এবং ঢাকা কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, মোগল আমলে খাজনা আদায় করা হতো হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসারে। কিন্তু হিজরি বর্ষপঞ্জি চন্দ্র মাসের হিসাবে চলার কারণে এখানে কৃষি খাজনা আদায়ে অসুবিধা হতো। খাজনা আদায়ের শৃঙ্খলা আনা ও প্রজাদের অনুরোধে মোগল সম্রাট আকবর বিখ্যাত জ্যোতিষবিদ আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজীকে বাংলা সালের সংস্কার আনার নির্দেশ দেন। তিনি সেই নির্দেশ অনুসারে হিন্দু সৌর ও হিজরি পঞ্জিকা বিশ্লেষণ করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম নির্ধারণ করেন। বাংলা সালের ইতিহাস সুস্পষ্টভাবে জানা না গেলেও অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও পণ্ডিত মনে করেন ১৫৫৬ সাল বা ৯৯২ হিজরিতে মোগল সম্রাট আকবর বাংলা সন চালু করেন।
আধুনিক গবেষকদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন, আকবর সর্বভারতীয় যে ইলাহী সন প্রবর্তন করেছিলেন তার ভিত্তিতেই বাংলায় আকবরের কোনো প্রতিনিধি বা মুসলমান সুলতান বা নবাব বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সে জন্য একে ‘সন’ বা ‘সাল’ বলা হয়। ‘সন’ কথাটি আরবি, আর ‘সাল’ হলো ফারসি। প্রথমে এ সালের নাম রাখা হয়েছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা নববর্ষ হিসেবে পরিচিতি পায়। এরপর চৈত্র মাসের শেষ দিনে (সংক্রান্তি) জমিদারি সেরেস্তারা প্রজাদের কাছ থেকে কৃষি ও রাজস্ব কর বা খাজনা আদায় করতেন। এ সময় প্রত্যেক চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সব খাজনা, মাসুল বা কর পরিশোধ করা হতো। এর পরের দিন পয়লা বৈশাখে ভূমির মালিকেরা নিজেদের অঞ্চলের প্রজা বা অধিবাসীদের মিষ্টি, মিষ্টান্ন, পান-সুপারি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন।
একই ধারাবাহিকতায় ১৬১০ সালে মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের নির্দেশে ঢাকায় সুবেদার ইসলাম খান চিশতি তাঁর বাসভবনের সামনে প্রজাদের শুভ কামনা করে মিষ্টি বিতরণ ও উৎসবের আয়োজন করতেন। খাজনা আদায় ও হিসাব নিকাশের পাশাপাশি চলত মেলা, গান বাজনা ও হালখাতা অনুষ্ঠান। পরবর্তী সময় ব্রিটিশ আমলে ঢাকায় মিটফোর্ডের নলগোলার ভাওয়াল রাজার কাচারিবাড়ি, ফরাশগঞ্জের রূপলাল হাউস, পাটুয়াটুলীর সামনে প্রতিবছর পয়লা বৈশাখে পুণ্যাহ অনুষ্ঠান হতো।
হালখাতার হালে পানি
পয়লা বৈশাখ সামনে রেখে পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা হালখাতা কিনছেন। অন্য সময়ের তুলনায় এই সময়ে হালখাতা বিক্রিও বেড়েছে।
হালখাতা উৎপাদন প্রতিষ্ঠান পুরান ঢাকার লোকনাথ বুক এজেন্সির পরিচালক আসিফুজ্জামান ইহাম প্রথম আলোকে বলেন, বছরজুড়ে হালখাতা বিক্রি হলেও পয়লা বৈশাখের আগে আগে এর বিক্রি বেড়ে যায়। অনেক প্রতিষ্ঠানের হিসাব এখন কম্পিউটারাইজড। তবে পুরান ঢাকার বেশির ভাগ ব্যবসায়ী খাতাপত্রেই হিসাব তুলে রাখেন। পুরান ঢাকার স্বর্ণব্যবসায়ী, শ্যামবাজারের আড়তদারেরা তাঁদের প্রধান ক্রেতা। তবে নতুন ঢাকায় ব্যবসা করছেন এমন অনেক স্বর্ণ ব্যবসায়ী তাঁদের তৈরি এই খাতা কিনে থাকেন। তিনি জানান, সরকারি হিসাবে শনিবার নববর্ষ পালন হলেও তাঁরা বাঙালি রীতি অনুসারে পরদিন রোববারও নববর্ষ উদ্যাপন করবেন।
পুরান ঢাকার চক মোগলটুলিতে স্টেশনারির প্রতিষ্ঠান রয়েছে মো. মনির হোসেনের। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, আগের রীতি অনুসারে পয়লা বৈশাখের আগে বাকি টাকা পরিশোধ সেভাবে না হলেও তাঁরা হালখাতা উৎসবের ঐতিহ্য ছোট পরিসরে হলেও ধরে রেখেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠান ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করা হয়েছে, সাজানো হয়েছে। লেনদেন রয়েছে এমন ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা রেখেছেন তিনি।
পুরান ঢাকার ইমামগঞ্জের হার্ডওয়্যার সামগ্রীর ব্যবসায়ী সানোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিষ্ঠান পরিচ্ছন্ন করার পাশাপাশি ব্যবসায় সাফল্য প্রার্থনার জন্য মিলাদের আয়োজন করেছেন। তিনি বলেন, পুরান ঢাকায় আগের মতো ধুমধাম করে হালখাতা হয় না। তবে ছোট পরিসরে হলেও ব্যবসায়ীরা এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। অনেক ব্যবসায়ী আছেন যাঁরা লেনদেনে স্বচ্ছতা রাখেন। তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে বাকিতে পণ্য নিয়েছেন এমন কয়েকজন ব্যবসায়ী পয়লা বৈশাখকে সামনে রেখে কয়েক দিন আগেই পুরোনো বছরের হিসাব চুকিয়ে দিয়েছেন।
নতুন ঢাকাতেও হালখাতার আয়োজন করেছেন স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা। আমিন জুয়েলার্সের নিউমার্কেট শাখার ব্যবস্থাপক মো. ইউনুস খান প্রথম আলোকে জানান, রাজধানীতে তাঁদের ছয়টি শাখা রয়েছে। সব শাখাতেই হালখাতা উৎসব করছেন তাঁরা। এ জন্য তাঁদের ক্রেতাদের কার্ড পাঠিয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘হালখাতার জন্য আমাদের প্রত্যেকটি শাখা প্রতিষ্ঠানকে সাজানো হচ্ছে। সারা বছর ধরে আমাদের তৈরি অলংকার যাঁরা কিনেছেন, তাঁদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাঁদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়নের ব্যবস্থা রেখেছি আমরা।’