রাজশাহী শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান কেন্দ্রীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানার বাঘটি ১২ বছর আগে মারা গেছে। সিংহের মৃত্যু হয়েছে সাত বছর আগে। এখন বাঘের খাঁচায় রয়েছে একটি টার্কি মুরগি, সিংহের খাঁচায় পেলিক্যান পাখি।
চিড়িয়াখানা ঘুরে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রাণীর দেখা মিলল না। থাকার মধ্যে একটি ভালুক, সেটিও অসুস্থ। অচেতন হয়ে পড়ে আছে। চিড়িয়াখানার ভেতরে এখনো প্রাণীদের চিকিৎসার কোনো ‘কোয়ারেন্টাইন শেড কাম ভেটেরিনারি ক্লিনিক’ হয়নি।
কেন্দ্রীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানাটি রাজশাহী সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে। সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, এটি আধুনিকায়নের জন্য ২০১০ সালে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। পার্কের মধ্যে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হলেও দর্শনীয় প্রাণী নেই।
চিড়িয়াখানা সূত্রে জানা গেছে, ১৯৯৭ সালের জুনে ৬ বছর ৪ মাস বয়সের একটি বাঘ ঢাকা চিড়িয়াখানা থেকে আনা হয়েছিল। নাম দেওয়া হয়েছিল সম্রাট। তবে কোনো সঙ্গী দেওয়া হয়নি। ১২ বছর নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়ে ২০০৮ সালের ২৯ নভেম্বর দুপুরে সম্রাট মারা যায়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাঘটি পুরোনো খাঁচায় ছিল। সেটির মৃত্যুর পর বাঘের জন্য নতুন খাঁচা বানানো হয়েছে, কিন্তু বাঘ আর আনা হয়নি।
একই দশা সিংহের খাঁচারও। নতুন খাঁচা আনা হয়েছে, কিন্তু সিংহ নেই। সেখানে রাখা হয়েছে একটি পেলিক্যান পাখি। চিড়িয়াখানায় দুটি সিংহ ও সিংহী ছিল। ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল সিংহী মারা যায়। তখনই সিংহটিও অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে ২৫ নভেম্বর সেটিও মারা যায়।
চিড়িয়াখানার কর্মচারীরা জানান, এর আগেই উট ও হায়েনা মারা গেছে। ২২টি গরু ছিল, তা–ও বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এদের খাঁচাও আর নেই। ২০১৫ সালের ২৩ এপ্রিল চিড়িয়াখানার পুরোনো খাঁচা থেকে একটি অজগর পালিয়ে যায়। এ নিয়ে তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়। কিন্তু অজগরের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাঁরা জানান, এক যুগের বেশি সময় ধরে চিড়িয়াখানায় নতুন করে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রাণী আনা হয়নি। একটি প্রাণী অসুস্থ হয়ে মারা গেলে সেটির স্থলে নতুন কোনো প্রাণী আনা হয়নি। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে একটি মেছো বাঘও অজগরের মতোই খাঁচার ফাঁক গলিয়ে পালিয়ে যায়। পরে নগরের হড়গ্রাম এলাকার লোকজন বাঘটিকে পিটিয়ে হত্যা করে। আগেও একটি মেছো বাঘ ছিল। সেটি অন্ধ হয়ে মারা যায়।
ভালুকের জন্য দুটি নতুন খাঁচা রয়েছে। চিড়িয়াখানার দর্শনীয় প্রাণী বলতে একটি ভালুক রয়েছে। সেটিও এখন অসুস্থ। ছয়-সাত দিন আগে মূল ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে সে আর ওপরে উঠে যেতে পারেনি। গত বুধবার খাঁচার পাশে গিয়ে দেখা যায়, খাঁচার মাঝখানে খড়ের ওপরে অচেতন পড়ে রয়েছে ভালুকটি। শরীরের এক জায়গায় দগদগে খত। বুধবার সকালে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছে। যেখানে ভালুকটি অচেতন অবস্থায় আছে, সেখানে শীত-বৃষ্টি থেকে সেটিকে রক্ষার জন্য মাথার ওপরে টিনের একটি ছাপরাঘর তৈরি করা হচ্ছে। দুজন কর্মচারী চট দিয়ে সেই ছাপরাটির বেড়া দিচ্ছেন। তাঁরা বলেন, ভালুকের কোনো হুঁশ নেই। হুঁশ থাকলে তাঁরা এখানে এসে বেড়া দেওয়ার সুযোগ পেতেন না।
চিড়িয়াখানার ভেটেরিনারি সার্জন মোহাম্মদ ফরহাদ উদ্দিন বলেন, ভালুক ও একটি গাধার গড় প্রত্যাশিত বয়স পার হয়ে গেছে। এগুলোর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কম। তা ছাড়া অন্যান্য চিড়িয়াখানায় ‘কোয়ারেন্টাইন শেড কাম ভেটেরিনারি ক্লিনিক’ থাকে। সেখানে অসুস্থ প্রাণীগুলোকে আলাদা করে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। যাতে জীবাণুতে আরেকটি প্রাণী অসুস্থ না হয়। আবার শুধু ভেতরে প্রাণীই নয়। বাইরে থেকে নতুন কোনো প্রাণী নিয়ে এলে তার দেহেও জীবাণু থাকতে পারে। প্রথমে এনে সেটিকে কোয়ারেন্টাইন শেডে রেখে চিকিৎসা দিয়ে এরপর সুস্থ হলে খাঁচায় দেওয়া হয়। রাজশাহী চিড়িয়াখানায় এমন কোনো ব্যবস্থা নেই। তিনি বলেন, একাধিকবার তিনি কর্তৃপক্ষকে এবারে অবহিত করেছেন। বিভিন্ন সভায় এ চাহিদার কথা বলেছেন।
নতুন খাঁচায় বেশ কিছু বানর, গাধা ও হরিণ রয়েছে। গাধাগুলোর মাথার ওপরে চিকন একটি শেড রয়েছে। কোনো বেড়া নেই। সেখানে বৃষ্টির ছাঁটও লাগে। প্রচণ্ড শীত থেকে রক্ষার জন্য চট দিয়ে ভালুকের মতো তাদেরও একটা ছোট জায়গা ঘিরে দেওয়া হয়েছে।
এই দৈন্যদশার কারণে দর্শনার্থীও কমে গেছে চিড়িয়াখানায়। যাঁরা আসেন, তাঁরাও হতাশ হন। বুধবার সন্তান নিয়ে এসেছিলেন এক দম্পতি। দেখার মতো উল্লেখযোগ্য কোনো প্রাণী না পেয়ে তাঁরা হতাশ। ভালুকের খাঁচাটি খোলা দেখে তাঁরা ভেতরে ঢুকে পড়েন কয়েকজন। একজন বলেন, ভেতরে তো ভালুক নেই। তখন কর্মচারীরা বলেন, ভালুক আছে, অসুস্থ। তাই খাঁচার দরজা খুলে তাঁরা ভেতরে ঢুকে কাজ করছেন। একটি শিশু বলে উঠল, ‘বাঘা-সিংহ নেই, এ কেমন চিড়িয়াখানা!’
যোগাযোগ করা হলে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল হক বলেন, বেশি প্রাণী না থাকার কারণে কোয়ারেন্টাইন শেড করা হয়নি। নতুন প্রাণী আনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তখন করা হবে।