কাকপক্ষীর হাগু পিসু নিয়েও যেসব লেখকেরা (পড়া যেতে পারে নেকখ) দু-লাইন লেখার যোগ্যতা রাখেন না, তাঁদের কেউ কেউ বলে বেড়ান হুমায়ূন আহমেদ সব সস্তা, হাল্কা ও চটুল লেখা লিখে গেছেন, যেগুলো এখন পড়লে তখন আর কিচ্ছু মনে থাকে না। বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান বিশাল গোল্লা ব্লা ব্লা ব্লা। এসব শুনে কারও কিছু যায় আসে কি না, জানি না। তবে তাঁদের প্রতি করুণা হয়।
মির্জা সাহেব, নান্দাইলের ইউনুস, বড় চাচা, রহিমার মা, কাদের, ‘রাজাকার’ ডাকা পাখি, বাদল, শুভ্র, টগর, তিতলি, কঙ্কা, বড় মামা, এলেমদার চোর, খাদক, নিষাদ, মজনু, মোনা, মিলি, মাজেদা খালা, মোবারক, হিমুর বাবা—আরও হাজারটা চরিত্র আছে (কাকে রেখে কার কথা বলি! হিমু, মিসির আলী, বাকের ভাই, রুপা—এদের কথা তো বললামই না। রক্তমাংসের মানুষ হয়েও তিনি কী করে এমন সব ডাইভার্সিফাইড চরিত্র সৃষ্টি করে গেছেন, ১০০ বছর পর তা গবেষণার জন্য রেখে দিলাম)। বাজি ধরে বলতে পারি, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস থাকবে যত দিন, ঠিক তত দিনই বহাল থাকবে তাঁর সৃষ্টিসমষ্টি। ইতিহাসের আরও বড় বড় লেখকের সৃষ্ট চরিত্রের ওপর স্যারের এসব ছোট চরিত্র একসময় রাজত্ব করবে, সেখান থেকে কেউ কেউ কোনো প্লট নিয়ে নোবেলও পাবে। মুখ্য চরিত্রগুলোর কথা তো বাদই দিলাম।
কয়েকটা ছোট কথা মনে করতে ও করিয়ে দিতে চাই—
পৃথিবীতে গুটিকয়েক লেখকদের মধ্যে হুমায়ূন স্যার একজন, যাঁর লিখিত বইগুলো তাঁর মৃত্যুর বহু পরও বছরের পর বছর বিক্রি সংখ্যায় টপ, নাম্বার ওয়ান, বেস্টসেলার।
হুমায়ূন আহমেদ এমন একজন লেখক, যাঁর হাত ধরে একটি পুরো প্রজন্ম বইপড়া শিখেছে; যাঁরা অস্বীকার করবেন সে সংখ্যা নেহায়েত স্বল্প। (তাদের পাছায় কালো কুচকুচা শিম্পাঞ্জির দ্বারা একটা হোৎকা লাথি মারা যেতে পারে।)
হুমায়ূন আহমেদ এমন একজন লেখক যাঁর সৃষ্ট একটি পাখি চরিত্রের মাধ্যমেই একটি জাতি, তার চেতনাকে প্রথমবারের মতো প্রকৃতভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিল। সেই কথা বলা পাখি ‘তুই রাজাকার’ না বললে হয়তো আমরা কখনো ‘রাজাকার’ শব্দের মানেটাই এত বৃহতভাবে জানতে পারতাম না।
যেখানে যুগ এমন এসেছে, নিজের লেখা বই নিজে কিনে কিনে পড়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর দেখি না, সেখানে তিনি সেই লেখক, যিনি ঢাবির মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠিত চাকরি ছেড়ে লেখালিখির মতো বিষয়কে পেশা হিসেবে নেওয়ার সাহস দেখাতে পারেন এবং সে মিশনে সর্বোচ্চ সফল হন।
বাংলা সাহিত্যে যেসব চরিত্র আজ অমরত্ব লাভ করেছে তার মধ্যে হিমু, বাকের ভাই অথবা মিসির আলী চরিত্রের পরিচিতির গণ্ডি ও জনপ্রিয়তা হয়তো আগামী শতবর্ষ পরও তাদের নিকট দূরত্বে অবস্থান করতে পারে, এমন চরিত্র হয়তো খুব নগণ্যসংখ্যকই সৃষ্টি হতে পারে।
আগামী ১০০ বছরের ইতিহাসে যদি আরও একজন হুমায়ূন আহমেদ না আসেন, তাহলে আমাদের পরবর্তী কোনো এক প্রজন্ম থেকে গল্প-উপন্যাস পড়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যাবে।
সর্বোপরি, বাংলা সাহিত্যে একজন হুমায়ূন যদি না আসতেন, তবে বাংলা সাহিত্যের আজকের এ রূপ, রস, গন্ধ, মাধুর্য, জৌলুস বহুলাংশে মলিন দেখাত। আবার যাঁরা অনেকেই এই স্বাদ আজ আস্বাদন করতে পারছেন, সেই পারাটাও হয়তো হতো না, যদি তিনি তাঁর কলমের সম্মোহনী জাদুতে বাঙালিকে আবার বইমুখো পাগলপারা না করতেন।
ভালো থেকো হুমায়ূন আহমেদ।
*মেহেদী হাসান তামিম: লেখক, গল্পকার