পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘আমরা একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি আমরা নির্ধারণ করি। যেকোনো দেশ তার বক্তব্য তুলে ধরতে পারে। দেশের মঙ্গলের জন্য আমরা কী কাজ করব না করব, আমাদের মৌলিক অবস্থানের ভিত্তিতে আমরা সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।’
ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূতের গতকালের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আজ মঙ্গলবার ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ মন্তব্য করেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে সেখানে কথা বলার আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেককে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় নেপালের রাষ্ট্রদূত বংশীধর মিশ্রার হাতে ঔষধসহ জরুরি চিকিৎসা সামগ্রী হস্তান্তর করেন।
ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার কৌশলগত জোট কোয়াড। এ ইস্যুতে চীনের মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওই কথা বলেন।
২০০৭ সাল থেকে শুরু হওয়া কোয়াড উদ্যোগ সম্প্রতি বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। এ ইস্যুতে গতকাল বাংলাদেশে চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন এ জোটকে চীনবিরোধী একটি ছোট গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করে বেইজিং। তাই চীন মনে করে, এতে যেকোনোভাবে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ককে ‘যথেষ্ট খারাপ’ করবে। কোয়াডে জড়ানোর বিষয়ে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে চীনের সরাসরি বক্তব্য এই প্রথম।
এমন মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘চীনের রাষ্ট্রদূত তার দেশের অবস্থানের কথা বলেছেন। যে প্রতিষ্ঠানের কথা উনি বলছেন, সেই প্রতিষ্ঠানের (কোয়াড) কেউই এখনো আমাদের অ্যাপ্রোচ করেনি। এটি একটু আগ বাড়িয়ে বলাবলি হয়েছে। তবে এটা নিয়ে বিশেষ বক্তব্য নেই।’
এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘এমনিতে চীন কখনো অন্যের বিষয়ে নাক গলায় না। আর এ রকম অ্যাগ্রেসিভ কখনো কাউকে বলতে শুনিনি। এটা খুবই দুঃখজনক। আমরা কী করব, না করব সেটা আরেকজন বড় করে বলছেন। দেশের মঙ্গলের জন্য যেটা প্রয়োজন, সেটাই আমরা করব।’ তিনি বলেন, ‘চীনের কাছ থেকে আমরা এ ব্যবহার আশা করিনি।’
চীনের রাষ্ট্রদূতকে এ বক্তব্যের জন্য কোনো বার্তা দেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা কী করি না করি, সেটা সব সময় মিডিয়াকে বলি না। উই হ্যাভ ডিফারেন্ট ওয়ে অব ডুয়িং থিঙ্কস। আমরা জানি, আমরা কী করব। সবকিছু বলে দিলে তো মহামুশকিল।’
গত মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকায় সংক্ষিপ্ত সফরে এসে চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী কোয়াড নিয়ে তাঁর দেশের উদ্বেগের কথা বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে জানিয়েছিলেন। এ অঞ্চলে কোয়াড যাতে আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে, সে জন্য দুই দেশের একসঙ্গে কাজ করার বিষয়ে বেইজিংয়ের প্রত্যাশার কথাও জানিয়েছিলেন চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী।
গতকাল সোমবার ঢাকায় কূটনৈতিক সাংবাদিকদের সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল মতবিনিময় সভায় চীনের রাষ্ট্রদূত আবারও কোয়াড নিয়ে বেইজিংয়ের আপত্তির কথা তুলে ধরলেন। কোয়াড প্রসঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থান কী ছিল, জানতে চাইলে চীনের রাষ্ট্রদূত তা এড়িয়ে যান। তবে তিনি বলেন, চীন সব সময় মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে কোয়াড হচ্ছে চীনবিরোধী একটি ছোট জোট। এটি চীনবিরোধী একটি ছোট ক্লাব। তাই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে জাপান।
কোয়াড থেকে বাংলাদেশকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়ে চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেন, ‘আমরা মনে করি, এই ছোট ক্লাবে বাংলাদেশের কোনোভাবে অংশগ্রহণ করাটা ঠিক হবে না। এতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যথেষ্ট খারাপ হবে।’
কোয়াডের অন্যতম শরিক ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূতের মন্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছে, পরিস্থিতির ওপরে তাঁরা নজর রাখছেন। চীনের বক্তব্য ও তার পাল্টা বাংলাদেশের নীরবতা নিয়ে প্রকাশিত সংবাদও নয়াদিল্লির গোচরে আছে।
ঢাকা-বেইজিং সম্পর্ক নিয়ে চীনের রাষ্ট্রদূতের মন্তব্য যথাযথ নয় বলে মনে করেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ সব সময় শান্তিপূর্ণ, গঠনমূলক, ভারসাম্যমূলক ও উন্নয়নমুখী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে চলেছে। যার মূল ভিত্তি বঙ্গবন্ধুর মূলমন্ত্র—‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়।’ দেশের উন্নয়নের স্বার্থে বাংলাদেশ যেকোনো উন্নয়নমূলক উদ্যোগের সঙ্গে রয়েছে, কোনো প্রতিরক্ষা কিংবা সামরিক জোটে যোগ দেয়নি। বাংলাদেশ যখন এ অবস্থা বজায় রেখে চলেছে, সেই প্রেক্ষাপটে চীনের রাষ্ট্রদূত যে মন্তব্য করেছেন, তা মোটেই যথাযথ নয়।