নানা নাটকীয়তা আর উত্তেজনার পর ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা প্রথম’নীতি থেকে সরে বাইডেন যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথাগত পররাষ্ট্রনীতিতে ফিরবেন, তা বুঝিয়ে দিয়েছেন নিজের অগ্রাধিকারের তালিকায় জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলার বিষয়টি রেখে। নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্টের পরিবর্তিত পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ধারাবাহিকতার জন্য সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলেই মনে করছেন কূটনীতিকেরা।
ট্রাম্প যুগের অবসান ঘটিয়ে জো বাইডেন যেমন বহুপক্ষীয় ব্যবস্থায় আস্থার ব্যাপারে ডেমোক্র্যাটদের চিরায়ত ধারায় ফিরবেন, তেমনি মানবাধিকার, গণতন্ত্র, সুশাসন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মতো বিষয়গুলোতে জোর দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
ভূরাজনৈতিক সমীকরণ, বিশেষ করে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক উন্নয়নের অগ্রাধিকারের কারণে বাংলাদেশ বিশেষ গুরুত্ব পায়। এখন দেখতে হবে, দক্ষিণ এশিয়াসহ পুরো ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির কারণে হোয়াইট হাউসের নতুন প্রশাসন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বেশি জোর দেবে, নাকি চীনের বিষয়টিকে মাথায় রেখে এক ধরনের ভারসাম্য বজায় রাখবে? সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই ভারসাম্যমূলক নীতিই দেখা যায়।
ঢাকা আর ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক সূত্রগুলোর সঙ্গে গত দুই দিনে কথা বলে আভাস পাওয়া যায় যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের জায়গা থেকে ডেমোক্রেটিক পার্টির একেবারে সরে আসার সুযোগ নেই। তবে ভূরাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে গড়ে ওঠা সাম্প্রতিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা যায়। অতীতে নানা বিষয় নিয়ে দুই পক্ষের (বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র) মতপার্থক্যের পরও ট্রাম্প প্রশাসনের সময় ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায় থেকেছে, যা ছিল ওবামা প্রশাসনের সময়ও। ভবিষ্যতে সম্পর্কের এই মাত্রা অব্যাহত রাখাই হবে বাংলাদেশের লক্ষ্য।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম গতকাল রোববার তাঁর দপ্তরে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এই নির্বাচনের পর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে কোনো পরিবর্তন হবে না। বরং আরও কিছু অভিন্ন ইস্যুতে গভীরভাবে কাজ করার সুযোগ হবে। নিকট অতীতে আমরা দেখেছি, অভিবাসন, জলবায়ু পরিবর্তন ও মুক্ত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র জোরালো ভূমিকা রেখেছে। এগুলো বাংলাদেশের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অ্যাজেন্ডা।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই বিষয়গুলোতে নতুন প্রশাসন আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ করবে বলেই আশা করা যায়। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি ও ক্ষমতাধর রাষ্ট্র। আমরা চাইব, আন্তর্জাতিক বিষয়গুলোতে যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকুক।’
বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরতের বিষয়ে জানতে চাইলে শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘নতুন প্রশাসনের নীতি কেমন হবে, সেটা তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে দেখেছি। প্রশাসনে যে পরিবর্তনই আসুক না কেন, আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, কোনো খুনিকে যুক্তরাষ্ট্রের মতো গণতান্ত্রিক দেশ আশ্রয়-প্রশ্রয় দেবে না। অতীতে এই দাবি ছিল, সামনেও দাবিটি জোরালোভাবে থাকবে।’
দেশে-বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে ধারণা পাওয়া যায় যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্র গণতান্ত্রিক সুশাসনের বিষয়গুলোতে তেমন উচ্চকণ্ঠ ছিল না। ফলে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে খুব একটা অস্বস্তিতে পড়তে হয়নি। আবার জলবায়ু পরিবর্তন, অভিবাসন, অর্থাৎ বাংলাদেশের জন্য অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো বৈশ্বিকভাবে রীতিমতো অগ্রাহ্য করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। এটি বাংলাদেশের জন্য সুখকর ছিল না। ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় আসায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিষয়গুলো অনিবার্যভাবে তুলবে। ফলে ভবিষ্যতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর যুক্তরাষ্ট্র এক হয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মানবাধিকার, সুশাসন, নির্বাচন ইত্যাদি বিষয় নিয়মিতভাবে বাংলাদেশের কাছে তুলতে পারে।
রানা প্লাজা ধস–পরবর্তী পরিস্থিতির প্রসঙ্গ টেনে এক কূটনীতিক প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৩ সালে বিষয়টিকে সামনে এনে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্যসুবিধা (জিএসপি) স্থগিত, পরবর্তীকালে সাধারণ নির্বাচন—সব মিলিয়ে দুই দেশের মধ্যে একধরনের দূরত্ব যে তৈরি হয়েছিল, সেটা অস্বীকারের সুযোগ নেই। পরে কিন্তু ওই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটিয়ে অব্যাহতভাবে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছে। কাজেই বাংলাদেশ ভবিষ্যতে কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেবে, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।
নতুন পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের মাত্রা কেমন হতে পারে, জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্সের (এসআইপিজি) সিনিয়র ফেলো মো. শহীদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশকে গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। কাজেই ভূরাজনৈতিক কৌশলকে বিবেচনায় রেখে দুই দেশের বর্তমান সম্পর্কের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে বলে মনে করি।’ তিনি আরও বলেন, পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশ যেখানে ছিল, তার চেয়ে অবস্থান অনেক সুসংহত হয়েছে। এটিকেও বিবেচনায় নিতে হবে। আবার এটাও মনে রাখতে হবে যে ডেমোক্রেটিক পার্টি গণতান্ত্রিক মূলবোধের বিষয়গুলোও তুলবে। কাজেই সামগ্রিকভাবে কতটা দক্ষতার সঙ্গে ধারাবাহিকতা রেখে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া যাবে, সেটা বাংলাদেশর ওপরও নির্ভর করবে।