একসময় ধনুষ্টঙ্কারে অনেক মৃত্যু ঘটত। ধনুষ্টঙ্কার নিয়ে ভয়, ভুল ধারণা ও কুসংস্কার ছিল।
ধনুষ্টঙ্কার বা টিটেনাসকে এখন আর নবজাতক, শিশু বা মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। একসময় দেশে নবজাতক মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল ধনুষ্টঙ্কার। শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোতে নবজাতক মৃত্যুর অন্যতম কারণ ছিল রোগটি। মায়েদের ও শিশুদের টিকা দেওয়ার মাধ্যমে এই মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। মায়েদের ধনুষ্টঙ্কারের টিকা দিয়ে নবজাতকের ধনুষ্টঙ্কার প্রতিরোধে বিশ্বকে পথ দেখিয়েছিল বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) টিটেনাসের টিকার প্রয়োগ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছিল।
বিশেষজ্ঞ শিশু চিকিৎসক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত শতকের আশির দশকে নবজাতক মৃত্যুর প্রথম তিন-চারটি কারণের মধ্যে ছিল ধনুষ্টঙ্কার। আমি ১৯৮১ সালে মেডিকেল কলেজে ইন্টার্নশিপ করেছিলাম। ওই সময় নবজাতককে ধনুষ্টঙ্কার থেকে বাঁচানো বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল। এখন আর ওই সমস্যা নেই।’
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১৯৮০ সালের এক প্রতিবেদন বলছে, ওই সময় বাংলাদেশে ১০ শতাংশ নবজাতকের মৃত্যু হতো ধনুষ্টঙ্কারে। কোনো কোনো দেশে এক-তৃতীয়াংশ নবজাতক মৃত্যুর কারণ ছিল ধনুষ্টঙ্কার।
ক্লোস্ট্রিডিয়াম টিটেনি নামের ব্যাকটেরিয়া ধনুষ্টঙ্কারের কারণ। এই জীবাণু কাটা বা ক্ষতস্থান দিয়ে শরীরে ঢোকে। জন্মের সময় নবজাতকের নাড়ি অপরিষ্কার ছুরি, কাঁচি বা ব্লেড দিয়ে কাটলে অথবা কাঁচা নাড়ি ময়লা কাপড়ের সংস্পর্শে এলে নবজাতক ধনুষ্টঙ্কারে আক্রান্ত হতে পারে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, যেকোনো বয়সের মানুষই ধনুষ্টঙ্কারে আক্রান্ত হতে পারে। গর্ভধারণকালে অথবা প্রসবের ৬ সপ্তাহের মধ্যে আক্রান্ত হলে তাকে ‘মাতৃ ধনুষ্টঙ্কার’ এবং জন্মের ২৮ দিনের মধ্যে হলে তাকে ‘নবজাতকের ধনুষ্টঙ্কার’ বলা হয়। কখনো কখনো ধনুষ্টঙ্কারে আক্রান্ত ব্যক্তির পেছনের দিক ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে যায়।
সরকারের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে (ইপিআই) এখন ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী সব নারীকে টিটেনাস টক্সয়েড টিকা দেওয়া হয়। মায়ের শরীরে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি শিশুর শরীরেও স্থানান্তরিত হয়। প্রজননক্ষম নারী বা মাকে টিকা দেওয়ার ফলে মূলত শিশুরা ধনুষ্টঙ্কার থেকে সুরক্ষা পাচ্ছে।
গত শতকের ষাটের দশক থেকেই কলেরার টিকা টিয়ে গবেষণা করে আসছিল আইসিডিডিআরবি। তারই ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠানটি চাঁদপুরের মতলবে ধনুষ্টঙ্কারের টিকা বা টিটেনাস টক্সয়েড নিয়ে গবেষণা করে।
১৯৭৪ সালের গবেষণায় ৫৩৬ জন নারীর মধ্যে একটি দলকে কলেরা টিকা এবং অন্যদের টিটেনাসের টিকা দেওয়া হয়েছিল। তাতে দেখা যায়, টিটেনাস টিকা পাওয়া নারীদের নবজাতকের মধ্যে ধনুষ্টঙ্কারের আক্রান্ত হওয়ার হার অন্য মায়েদের সন্তানদের চেয়ে কম। গবেষকেরা দেখেন, টিটেনাস টক্সয়েড পাওয়া নবজাতকের মৃত্যুহার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে এসেছে। এ নিয়ে তিনজন বিদেশি গবেষকের একটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ ১৯৮০ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বুলেটিনে ছাপা হয়। ওই প্রবন্ধের উপসংহারে বলা হয়েছিল, সব অন্তঃসত্ত্বা নারীকে টিটেনাস টিকা দিয়ে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে নবজাতক মৃত্যু এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে।
গত শতকের আশির দশকে নবজাতক মৃত্যুর প্রথম তিন-চারটি কারণের মধ্যে ছিল ধনুষ্টঙ্কার। ওই সময় নবজাতককে ধনুষ্টঙ্কার থেকে বাঁচানো বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল। এখন আর ওই সমস্যা নেই।অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা বিশেষজ্ঞ শিশু চিকিৎসক
এসব গবেষণায় যুক্ত ছিলেন আইসিডিডিআরবির ইমেরিটাস বিজ্ঞানী ডা. মোহাম্মদ ইউনুস। তিনি তখন আইসিডিডিআরবির মতলব ফিল্ড স্টেশনের প্রধান ছিলেন। মোহাম্মদ ইউনুস প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব গবেষণা থেকে আমরা নিশ্চিত হতে পারি যে টিটেনাস টক্সয়েড মাকে ধনুষ্টঙ্কার থেকে সুরক্ষা দেয়, টিকা নেওয়া মায়ের সন্তানকে সুরক্ষা দেয়। আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে যাচ্ছিলাম যে প্রজননক্ষম (১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী) নারীকে টিটেনাস টক্সয়েডের আওতায় আনা গেলে ধনুষ্টঙ্কার কমানো সম্ভব হবে। এখন সেটা হয়েছে।’
মোহাম্মদ ইউনুস বলেন, টিটেনাস টক্সয়েড বা ধনুষ্টঙ্কারের টিকা নিয়ে প্রবন্ধগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বুলেটিনে প্রকাশ পাওয়ার পর তা বিশ্বের বিজ্ঞানী, গবেষক ও জনস্বাস্থ্যবিদদের দৃষ্টি কাড়ে। বিষয়টির দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যও বিশেষ নজর দেয়। বাংলাদেশসহ আরও অনেক দেশে নানা ধরনের গবেষণা হয়।
অন্যদিকে মতলবের অভিজ্ঞতা সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা এবং যশোরের অভয়নগর উপজেলায় আবার যাচাই করা হয়। এই প্রচেষ্টায় সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের সঙ্গে ছিল আইসিডিডিআরবি। কাছাকাছি সময়ে সরকারের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে (ইপিআই) টিটেনাসের টিকা অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
ইপিআইয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এখন ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী দেশের সব নারীকে টিটেনাসের টিকা দেওয়া হয়। আর জন্মের পর শিশুদের যে পেন্টাভ্যালেন্ট (ডিপথেরিয়া, হুপিংকাশি, ধনুষ্টঙ্কার, হেপাটাইটিস-বি, হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি) টিকা দেওয়া হয়, সেগুলোর মধ্যে ধনুষ্টঙ্কারের টিকাও আছে। নারীদের প্রায় তিন বছর সময়ের মধ্যে মোট পাঁচটি ডোজ টিকা দেওয়া হয়। দেশে ১৫-৪৯ বছর বয়সী ৮৫ শতাংশ নারী এবং শিশুদের ৯৪ শতাংশ এই টিকা পাচ্ছে। এর ফলে ধনুষ্টঙ্কার দেশ থেকে একেবারে নির্মূল না হলেও রোগটি এখন দুশ্চিন্তার কারণ নয়। উন্নয়নশীল অনেক দেশেও এই রোগ নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে।