বিশ শতকের দ্বিতীয় সিকিতে হিন্দু-মুসলমানের যে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা ভারতভাগকে অনিবার্য করে তুলেছিল, তার বিপ্রতীপ স্রোতেই এসেছিল ভাষা আন্দোলনের জোয়ার। ভাষা আন্দোলনের মূল কথা ছিল জীবনের সর্বস্তরে মাতৃভাষা বাংলার ব্যবহার। আমাদের প্রাত্যহিক কাজ থেকে রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম সর্বত্র সবকিছু চলবে বাংলায়। সে জন্য দাবি ছিল বাংলাকে সর্বত্র প্রচলনের সাংবিধানিক স্বীকৃতি। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধানে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়া হলো বটে, তবে তার কার্যকারিতা স্থগিত রাখা হলো ২০ বছরের জন্য। ১৯৬২ সালের সামরিক শাসনতন্ত্রে আবার একই কথা বলা হলো। ফলে তীব্র প্রতিক্রিয়ায় ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ রূপান্তরিত হলো ‘বাংলা ভাষার রাষ্ট্র চাই’ দাবিতে।
আমাদের কৈশোরকালে ১৯৬০–এর দশকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলা ব্যবহারের একটা ঐকান্তিক আগ্রহ চোখে পড়ত। সে আগ্রহ অবশ্য অত্যাবশ্যকীয় ছিল মূলত শহুরে মধ্যবিত্তদের জন্য। পূর্ব বাংলার প্রায় সব মানুষই তো তখন গ্রামবাসী। তাদের জীবনের সবকিছুই তো বাংলায়। ভাষাবিজ্ঞানী ব্লুমফিল্ড যে আঞ্চলিক ভাষাকে বলেছিলেন ভাষার প্রাণ, বাংলার গ্রামের মানুষ তো সেই ভাষাতেই কথা বলে। সেই ১৯৬০–এর দশকেই একুশে ফেব্রুয়ারি কাছাকাছি এলে বাংলা ভাষায় দোকানপাটের সাইনবোর্ড লেখার তোড়জোড় চোখে পড়ত। গাড়ির নম্বরপ্লেটে বাংলা লেখা হতো সাময়িকভাবে হলেও। যাঁরা এসব করতে ব্যর্থ হতেন, তাঁদের কপালে অনিবার্য ছিল বিশ্রী আলকাতরা। একুশের সংকলন বেরোত দেদার। লেখার মান আর অঙ্গসজ্জায় সেগুলো অতি আকর্ষণীয়। সংকলন প্রকাশের নামে বিজ্ঞাপন-ব্যবসা তখনো শুরু হয়নি।
১৯৬৬ সালে ছয় দফা ঘোষণার পর তৎকালীন পূর্ব বাংলায় নতুন করে বাঙালিয়ানার জোয়ার আসে। সে জোয়ারে আবেগ-উদ্দীপনা-উত্তেজনার প্রাচুর্য ছিল। সঙ্গে ছিল স্বাধিকার অর্জনের স্বপ্নও। ফলে বাংলা ভাষায় সবকিছু করার একটা প্রস্তুতি শুরু হয়। এর একটা বড় দিক ছিল শিক্ষার উচ্চতর স্তরের জন্য বাংলায় বই লেখার উদ্যোগ। দেশের প্রথিতযশা বিজ্ঞানী বা চিকিৎসকেরাও এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশে সব রাষ্ট্রীয় কাজকর্মের ভাষা হবে বাংলা, এই নিয়ে কারও দ্বিধার কোনো অবকাশ ছিল না। এরই ধারাবাহিকতায় এসেছিল সব সরকারি কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহারের জন্য বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ। আইন-আদালত আর শিক্ষার উচ্চস্তরেও বাংলা ব্যবহারের চল শুরু হয়েছিল। পরিভাষা তৈরির ব্যাপক সাফল্যও চোখে পড়েছিল।
এর প্রথম উল্টোস্রোত শুরু হয় ১৯৭৫-পরবর্তী সামরিক শাসনামলে। সরকারি কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহারের নির্দেশ এবং সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের ভাষা হিসেবে বাংলার অবস্থান রদ না করেই বলা হলো যে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের কাছে নথি উপস্থানে যে সারসংক্ষেপ তৈরি করা হবে, তার ভাষা হবে ইংরেজি। এই নির্দেশ নিশ্চিতভাবেই সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তবে উর্দিপরা সামরিক শাসকেরা ইংরেজিতে বাতচিত পছন্দ করেন ব্রিটিশ আর পাকিস্তানি জেনারেলদের পথ ধরে। তাই সেই স্তরে ইংরেজিই চালু হলো।
দ্বিতীয় ধাক্কাটি এল আদালত থেকে। আইনের মারপ্যাঁচে বলা হলো যে মামলা-মোকদ্দমায় বাংলার ব্যবহার হবে; কিন্তু ইংরেজি ব্যবহার করা যাবে না এমন তো বলা হয়নি। উচ্চ আদালতের রায় লেখার ক্ষেত্রে ইংরেজির একটা আধিপত্য বরাবরই ছিল; ওই মারপ্যাঁচ তাকে আরও প্রবল করে দিল। নিম্ন আদালতের ইংরেজির ব্যবহারে বাধা রইল না।
তবে সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহারে এসবের চেয়েও বড় ধস নামাল ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের অবিশ্বাস্য উত্থান। ১৯৮০–র দশকে মধ্যবিত্তদের ব্যাপক হারে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে অভিবাসন প্রয়াস এর একটা বড় কারণ। শিক্ষার্থী হিসেবে ইংরেজি ভাষাভাষী অঞ্চলে উচ্চশিকার জন্য যাওয়াও এ সময়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়া প্রবল হয়ে ওঠে। ঢাকাসহ বড় নগরগুলোতে গড়ে ওঠে উচ্চ মানের ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। এসব স্কুল তুলনামূলকভাবে ভালো বেতন দিয়ে ভালো শিক্ষক আর চকচকে অবকাঠামো নিয়ে দ্রুত বাংলাদেশের নবউত্থিত ধনিক আর উচ্চবিত্তদের আকৃষ্ট করে। ছেলেমেয়েদের ইংরেজি স্কুলে পড়ানো একরকমের মর্যাদায় পরিণত হয়। আমরা সবাই দ্রুত এই পাপে জড়িয়ে পড়ি।
ইংরেজি মাধ্যমের এই জনপ্রিয়তা নগরের অলিগলিতে কিন্ডারগার্টেন স্কুল স্থাপনের জন্য ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের আগ্রহী করে তোলে। কোনো ক্ষুদ্র গলির অপরিসর বহুতল ভবনের কয়েকটি কক্ষ নিয়ে সাজানো হয় অধিকাংশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল। আমাদের প্রতিষ্ঠিত বাংলা স্থলগুলোর সুপরিসর ভবন, খেলার মাঠ, যোগ্য শিক্ষক চোখের আড়াল হতে থাকে। ক্রমে গ্রামাঞ্চলেও গড়ে ওঠে কিন্ডারগার্টেন। এভাবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষায় বাংলা মাধ্যম অন্তত সম্মানের আসনটি হারায়।
এসব সত্ত্বেও অনুপাত বিবেচনা করলে বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বাংলা ভাষাতেই শিক্ষা লাভ করে। এর কারণ হিসেবে অনেকেই বলতে পারেন যে সব স্কুল-কলেজে ইংরেজিতে পড়ানোর মতো অত শিক্ষক আমাদের নেই। বাংলা মাধ্যম প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলো অবশ্য অন্যভাবেও তাদের মানসিক পরাজয় ডেকে এনেছে। তারা নিজ স্কুলেই একটা ‘ইংরেজি ভার্শন’ ধারার স্থান দিয়েছে।
আমাদের দেশে মাদ্রাসাগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রচুর। এদের মধ্যেও একাধিক ধারা আছে। তবে সব ধারারই শিক্ষার মাধ্যম আরবি। এর শিক্ষকেরা আরবির পাশাপাশি অনেক সময় উর্দু ব্যবহার পছন্দ করেন। কওমি মাদ্রাসার অধিকাংশ শিক্ষার্থী গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র পিতা–মাতার সন্তান। পরবর্তী সময়ে এদের জীবিকা অর্জনেও আরবি-উর্দুর প্রাধান্য থেকে যায়। বড় ভোটব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে সব সরকারই মাদ্রাসায় মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যায়।
উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে মাতৃভাষা বাংলা ব্যবহারের বিষয়টি আরও জটিল। অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা ও সামাজিক বিজ্ঞানের অধিকাংশ বিষয় বাংলাতেই পড়ানো হয়। কিন্তু বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ও বাণিজ্য অনুষদের শিক্ষায় ইংরেজির প্রাধান্য দেখা যায়। এসব অনুষদের সব শিক্ষক যে ইংরেজিতে খুব দক্ষ তা নয়; তবে তাঁরা ইংরেজি বই পড়ে পড়ান বলে কাজটা সহজ হয়। তাঁরা উচ্চশিক্ষায় বাংলা বইয়ের অভাবকে এ জন্য দায়ী করেন। এই দায়টা আসলে তাঁদেরই; কেননা উচ্চশিক্ষায় বাংলায় বিজ্ঞান, চিকিৎসা বা বাণিজ্যের বই তাঁদেরই লিখতে হবে। চীন বা জাপানের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদান মাতৃভাষায় সম্ভব হলে, বাংলায় তা আরও বেশি সম্ভব।
বাংলাদেশে গত তিন দশকে গড়ে ওঠা ‘প্রাইভেট’ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইংরেজিতে পাঠদানের প্রবণতা প্রকাশ্য। তবে শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র কয়েকটিতেই ইংরেজিতে পাঠদানের মতো যোগ্য শিক্ষক আছেন। ফলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষার মাধ্যম জগাখিচুড়ি।
আমাদের গণমাধ্যম বাংলাভিত্তিক। মুদ্রিত সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনের পর্দা—দুই ক্ষেত্রেই এটি সত্য। বাংলা সংবাদ ও সাময়িকপত্রগুলো মাতৃভাষা বাংলার ব্যবহারে যথেষ্ট অবদানও রাখছে। তবে টিভি চ্যানেলগুলোর বাংলা ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটা আপত্তির জায়গা রয়েছে। এসব চ্যানেলে নাটক ও অন্য কিছু ক্ষেত্রে বিকৃত বাংলা ব্যবহার হচ্ছে। বেশ কিছু সংলাপে আঞ্চলিক ভাষার নামে যে ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে, তা আদৌ কোনো অঞ্চলের ভাষা নয়; বরং বিকৃতি। পাশাপাশি ইংরেজি শব্দ দিয়ে বাংলা বাক্য তৈরি হাস্যকর পর্যায়ে পৌঁছেছে। এর প্রধান উদ্গাতা এফএম রেডিওর চ্যানেলগুলো। কিন্তু, সুতরাং, যেমন, প্রভৃতি সুমধুর বাংলা ধ্বনিকে নির্বাসন দিয়ে বাট, সো, লাইকের দৌরাত্ম্যে আমরা অস্থির। অথচ বাক্যের মাঝখানে প্রায়ই একটা অনাবশ্যক ‘কিন্তু’ বসানো হচ্ছে।
আবার ফিরে আসি সরকারি দপ্তর আর আদালতে বাংলা ব্যবহারের প্রসঙ্গে। বিসিএস পাস কর্মকর্তারাই এখন আমাদের প্রশাসনের মেরুদণ্ড। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা বিদেশে অভিবাসন আর ‘করপোরেট’ বিশ্বে ব্যস্ত। তা ছাড়া ইংরেজির চমক থাকলেও বিসিএস পরীক্ষায় তাঁরা খুব ভালো করেন না। বিসিএস কর্মকর্তারা সরকারি নথিতে বাংলাই ব্যবহার করেন। সবাই না হলে তাঁদের অনেকে ভালো ইংরেজিও জানেন। তবে এই কর্মকর্তাদের প্রায় সবাই প্রাত্যহিক ব্যবহারে ইংরেজি বাক্য, নিদেনপক্ষে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে ‘চৌকস’ হওয়ার আনন্দ পেতে চান।
নিম্ন আদালতের বিচারকেরাও একই পদ্ধতিতে নিয়োগ পান। তাঁদের রায়ও বাংলাতে লেখা হয়। তাঁদের মানসিকতাতেও ইংরেজি বাক্য বা শব্দ ব্যবহারে আনন্দ পাওয়ার প্রবণতা আছে। উচ্চ আদালতে ইংরেজিতে রায় লেখার প্রাধান্য সম্ভবত এখনো বিদ্যমান। কোনো কোনো বিচারপতি অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বাংলায় রায় লিখেছেন। কিন্তু উচ্চ আদালতে ভাষার ক্ষেত্রে তাঁদের অনুসারী স্বল্প। এ ক্ষেত্রে তাঁরা আইনের গ্রন্থের ভাষা, উদারণ হিসেবে রায়ের ভাষা কিংবা বর্তমানে প্রদত্ত রায় অন্য স্থানে উদাহরণে ভাষার সমস্যা প্রভৃতি প্রতিবন্ধকতার কথা বলেন। অথচ আমাদের জানামতে, নেপাল মাতৃভাষায় মামলার রায় লেখে। জার্মান বা ফরাসি ভাষার রায়ের উদাহরণ কি কোনো ইংরেজিভাষী আদালতে উপস্থাপিত হয় না?
প্রসঙ্গ শেষ করতে চাই, বিশ্বায়নের এই যুগে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহারের সম্ভাবনা নিয়ে। অনেকে মনে করেন যে কম্পিউটারের ভাষা ইংরেজি; সুতরাং আমাদের তথ্যপ্রযুক্তির জগতে প্রবেশ করতে হবে ইংরেজি ভাষা দিয়ে। চীন ও জাপানির মতো অন্তত দুই হাজার বর্ণমালা নিয়ে গঠিত ভাষা তথ্যপ্রযুক্তি, বিশেষত কম্পিউটার ব্যবহারে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়ে ওই চিন্তাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করেছে। আমাদের সাফল্যও তো কম নয়। শহীদলিপি, বিজয় কি–বোর্ড, নিকস ফন্ট প্রভৃতি থাকার পরও কম্পিউটার ব্যবহারের সব স্তরে বাংলা ব্যবহারে আমরা পিছিয়ে আছি।
একুশে ফেব্রুয়ারির সাত দশক পর, সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের ভাষারূপে বাংলার স্বীকৃতির পাঁচ দশক পর বাংলার ব্যবহার এখনো আক্রান্ত হয়। দ্বিধাগ্রস্ত হয়—এ আমাদের সবার জন্যই লজ্জার। কিন্তু এ আশঙ্কার স্থলটি মূলত নগরে কৃষিনির্ভর বাংলার বিপুল মানুষ এখনো সর্বতোভাবে ‘বাংলা’। নগরের সাইনবোর্ড বা বাড়ির ইংরেজি নাম কিংবা সর্বশিক্ষিতদেরও ইংরেজিতে বিয়ের নিমন্ত্রণপত্র ছাপানো অথবা ঘরে ঘরে হিন্দি চ্যানেলের দৌরাত্ম্য—এসব আমাদের বাঙালিয়ানাকে চ্যালেঞ্জ করছে বটে। কিন্তু মানুষের সচেতনতা আর রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি পৃষ্ঠপোষকতাকে সমন্বিত করলে বাংলাদেশ তো সর্বক্ষেত্রে ‘বাংলা’ই হবে।
সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ: উপাচার্য, রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা