নিজের জীবন নিয়ে খামখেয়ালি আচরণ করলেই পাগল বলা যাবে না। তবে ম্যালকম আরনল্ডের গল্প একেবারে সাদা কাগজের মতো নীরসও নয়। অস্ট্রেলিয়ার এই নাগরিক ২০০৪ সাল থেকে স্থায়ীভাবে আছেন বাংলাদেশে। এ দেশে তাঁর নাগরিকত্ব নেই। তাই বছর বছর ভিসার মেয়াদ বাড়াতে হয় টাকা দিয়ে। এর আগে বছর দশেক পাহাড়ে উঠে বসেছিলেন ভিড়ভাট্টা এড়াতে। তাও বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে নয়, অস্ট্রেলিয়ায়। তারও আগে যুবক বয়সেই তিতিবিরক্ত হয়ে চাকরি ছেড়েছিলেন শুধু ছবি আঁকবেন বলে। সেই ম্যালকম নানা পথ ঘুরে ১৮ বছর ধরে আছেন খুলনা শহরের সোনাডাঙায় সবুজ রঙের দেয়ালের একটি ঘরে। যেখানে দিনরাত কোলাহলই তাঁর জীবন। বাগেরহাটের রামপালের পেড়িখালী গ্রামের হালিমা বেগমকেও সেখানেই থাকতে হয়।
ম্যালকমের বয়স এখন ৭৪। হিসাব যন্ত্রের সব সংখ্যা ব্যবহার করে হালিমা বেগমের বয়স বের করা হলো ৫১ বছরের কাছাকাছি। অসম বয়সী, ভিন্ন দেশের নাগরিক আর দুই ধর্মের এ দুজন মানুষের বড় হওয়ার গল্পেও ব্যবধান আকাশ-পাতাল। একজন অস্ট্রেলিয়ায় সচ্ছল পরিবারের, আরেকজন পেড়িখালী গ্রামে প্রায় ভিখারি জীবনে বেড়ে ওঠা মানুষ। এত সব অমিলই তাঁদের জীবনে মিল ঘটিয়েছে বললে কম হয় না। সম্ভব হয়েছে ম্যালকম আরনল্ড নামের শখের ছবি আঁকিয়ের জন্যই। হালিমার অর্জন হচ্ছে, ম্যালকম এখন ভালোবাসে বাংলাদেশকেও। তাই তাঁর ছবিতে উঠে আসে জোয়ারে ডুবে যাওয়া উপকূলের বাড়ির ছবি, গোলপাতার ছাউনি দেওয়া সে ঘরের সামনে নৌকা। অথবা পার্বত্যাঞ্চলের দৃশ্য।
ম্যালকম আরনল্ড বাংলাদেশে প্রথম এসেছিলেন ২০০১ সালে আটজনের এক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে। সরকারিভাবে তাঁদের আনা হয়েছিল একটি বইয়ের কাজের জন্য। সঙ্গী–সাথি নিয়ে ম্যালকম গেলেন সুন্দরবন দেখতে। ফেরার পথে তাঁরা ভাবলেন মোংলার কাছে বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কার্যক্রম সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। বন্দর, ঘাট দেখে পৌঁছালেন বাণীয়া শান্তার কাছাকাছি। এদিকে পেড়িখালীর হালিমা শৈশবে বাবা-মাকে হারিয়ে অনাথ হয়েছেন। বড় চার ভাইয়েরা বোনের দায়িত্ব নিতে অপারগ। এমনকি ছোটবেলায় মেরে তাঁকে বালতির ভেতর বসিয়ে রাখার ঘটনাও ঘটেছে বহুবার। হাতে–পায়ে একটু বড় হলে শুরু করলেন মানুষের বাড়িতে গৃহশ্রমিকের কাজ। তাই হালিমা বেগমের শিক্ষার দৌড় তৃতীয় শ্রেণির বেশি এগোয়নি।
খুলনা শহরেও গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতেন হালিমা। সেখানেও মারধর, নির্যাতন চলত। তবুও এরই মধ্যে নিজের আগ্রহে টেলিভিশন, রেডিও শুনে শুনে একটু–আধটু ইংরেজি শিখেছেন। লিখতে বা পড়তে না পারলেও বলতে ও বুঝতে পারেন। বেসরকারি এক উন্নয়ন সংস্থার হয়ে তিন হাজার টাকার মাসিক বেতনে কাজ নিয়েছেন ওই এলাকায়। ম্যালকমদের দল সুন্দরবন ঘুরে মোংলায় পৌঁছানোর পর পথে দেখা হলো দুজনের। আশপাশের খবর নিতে নিতে কিছুক্ষণের আলাপ। একজন সরকারি সফরে আসা কৃতী, অন্যজন সব হারানো সামান্য কর্মী। দুজনই লিখে রাখলেন চিঠি পাঠানোর ঠিকানা।
ম্যালকম চলে গেলেন অস্ট্রেলিয়ায় আর স্বামী পরিত্যক্তা হালিমা বেগম একমাত্র কন্যাসন্তানকে নিয়ে লড়াই করে চলেছেন বাদাবনের কাছে সহায়তা কর্মী হিসেবে। ২০০৪ সালে গুরুতর অসুখ ধরা পড়ল হালিমার। চিকিৎসকেরা বলেই দিলেন, আশা শেষ। বিপদে খড়কুটো আঁকড়ে ধরার মতো হালিমা সহযোগিতা চাইলেন কাছের-দূরের যার কথা মনে এলো তার কাছেই। মেয়ে ফাতেমার জন্য হলেও তাঁর বেঁচে থাকা জরুরি। মনে পড়ল কয়েক বছর আগে ঠিকানা লিখে রাখা কাগজটার কথা।
নিশ্চিত ছিলেন, উত্তর আসবে না। ওদিকে চিঠি পেয়ে শিল্পীর মনে পড়ল সুন্দরবন আর তাঁর কাছাকাছি দেখা পাওয়া সেই নারীর কথা। নাতাশা আর নেটি নামের দুই কন্যাসন্তান তখন বাবা ম্যালকমের সঙ্গেই থাকে। তবে তাদের মায়ের সঙ্গে বাবার বিচ্ছেদ হয়েছে আরও ১৪ বছর আগে। মেয়েদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে আঁকিয়ে চলে এলেন বাংলাদেশে বন্ধুর চিকিৎসা করাতে। চিকিৎসা চলাকালেই এই অসম বন্ধুত্ব থেকে তাঁদের সম্পর্ক হলো প্রণয়ের। অথচ হালিমার সুস্থ হওয়ার আশা ক্ষীণ। বয়স্ক বিদেশি এ শিল্পী বন্ধু দিনরাত তাঁর হাত ধরে থাকে। আর বিশ্বাস রাখতে বলে, সব ঠিক হয়ে যাবে।
সব ঠিক হয়েছে বটে। দুজন এক বাড়িতে থাকে এই তাঁদের নির্ভরতা। বৃদ্ধ ম্যালকমের হাতের লাঠি হালিমার নাতি জান্নাত। নানাকে সে যখন-তখন ধমকেও রাখে। কিন্তু হালিমা সে যাত্রায় নতুন জীবন পেলেও বাংলাদেশে থাকার মূল্য দিয়ে প্রায় নিঃস্ব হয়েছেন ম্যালকম আরনল্ড। স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া ফিরেছিলেন থিতু হতে। কিন্তু হালিমার জন্যই আবার ফিরতে হয়েছে বাংলাদেশে। এ দেশের নোনা মাটি কাদায় অভ্যস্ত হালিমার মেয়েটি তো রূপসার পাড়ে থাকে।
ভালোবাসার টানে ম্যালকমও ১৮ বছর ধরেই রয়ে গেলেন বাংলাদেশে। তবে এ ৭৪ বছর বয়সে এসে জীবনের দাম চড়া সুদে দিতে হচ্ছে দুজনকে। ডায়াবেটিস, হাড় ক্ষয়, হৃদ্রোগ প্রায় অচল করে দিয়েছে ম্যালকম আরনল্ডকে। হাতটা অচল বলে আর তুলিতে রং লাগে না। উঠে আসে না বাংলাদেশের মানুষের মুখ, খুলনা শহরে রূপসা ঘাটের পাশে দেখা শীতের চাদরে ঢাকা মানুষের দৃশ্য। আগের ছবিগুলোও অবিক্রীত অবস্থায় রয়েছে ঘরে।
করোনার জন্য গত বছর অস্ট্রেলিয়া না গেলেও তাঁর নাগরিকত্ব থাকা নিয়ে সমস্যা হয়নি। কিন্তু এখন সোনাডাঙার বাড়ির মাসে সাত হাজার টাকার ভাড়া বাকি শুরু হয়েছে। নিত্যদিনের অতি জরুরি ওষুধটা কেনার অবস্থাও এ দম্পতির নেই। ম্যালকমের সতীর্থদের সহযোগিতায় ২০১৯ সালের জুনে রাজধানীর দৃক গ্যালারিতে এক সপ্তাহের একটা প্রদর্শনী হয়েছে। দু-চারটি ছবি বিক্রি হয়েছে। এই ম্যালকমের এখন পর্যন্ত শেষ উপার্জন। ভালো থাকবেন বলেই অনেক অমিলের ভেতরও যৌথ হয়েছিলেন। সে ভালোবাসায় নির্ভরশীলতা, শ্রদ্ধা সব ছিল বলেই অন্য দেশের মানুষ হয়েও ম্যালকমের ছবিতে উঠে আসে বাংলাদেশের মুখ। হালিমা বেগমের সঙ্গে আলাপের শেষে তিনি বললেন, নিজের জন্য ভাবি না; কিন্তু যে মানুষটা আমার জন্য সব ছেড়ে এ দেশে এসে থেকে গেল চোখের সামনে তাঁর এমন ফুরিয়ে যাওয়ায় নিজেকে খুব অসহায় লাগে।
ম্যালকমের আঁকা বেশ কিছু ছবি এখনো রয়েছে তাঁদের ঘরে। বিদেশির চোখে দেখা আমাদের দেশের ছবি যদি কারও ভালো লাগে তাহলে যোগাযোগ করতে পারেন ০১৭৩৬৬৭৬৫৯৮ নম্বরে। কে জানে হয়তো সবার একটু আগ্রহই আবার ফিরিয়ে দিতে পারে ম্যালকম আরনল্ডের জীবনের রং।