বিশ্বব্যাপী বিস্তার, সুখ্যাতি ও বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতার কারণে লন্ডনভিত্তিক জরিপ পরিচালনা প্রতিষ্ঠান ক্যান্টারের এনএমএসের গ্রহণযোগ্যতা সর্বাগ্রে।
বাংলাদেশে সংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যা জানার নির্ভরযোগ্য কোনো উপায় নেই। কিন্তু ছাপা হওয়ার পর সেই সংবাদপত্রের কতগুলো কপি বিক্রি হচ্ছে, আর সেগুলো কতজন পড়ছেন, বাজার গবেষণা কিংবা বিজ্ঞাপন পরিকল্পনার জন্য তা জানা জরুরি। এর সঙ্গে জানা জরুরি পাঠক সম্পর্কে তথ্য—কারা পত্রিকা পড়ছেন, পত্রিকায় কী পড়ছেন, কোন এলাকা থেকে পড়ছেন এসব। পাঠক-দর্শক-শ্রোতাদের গণমাধ্যম ব্যবহারের এমন ধরন ও অভ্যাস নিয়েই করা হয় ন্যাশনাল মিডিয়া সার্ভে (এনএমএস) বা জাতীয় গণমাধ্যম জরিপ।
সংবাদপত্র ছাড়া টেলিভিশন, রেডিও ও বিলবোর্ডের বিস্তৃতি এবং এ–সংক্রান্ত জনতাত্ত্বিক তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে দেশব্যাপী করা এ জরিপে। সেই সঙ্গে নানা পণ্য এবং টেকসই ও দীর্ঘ ব্যবহার্য পণ্য ও সেবার ব্যবহার ও বিস্তার সম্পর্কে এ গবেষণায় তথ্য পাওয়া যায়।
জাতীয় গণমাধ্যম জরিপ ২০২১ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশে প্রচারমাধ্যমগুলোর পাঠক-দর্শক-শ্রোতার সংখ্যা, বিস্তৃতি ও জনতাত্ত্বিক তথ্য বিশ্লেষণ নিয়ে ২৫ বছর ধরে এই জরিপ পরিচালনা করে আসছে আন্তর্জাতিক বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যান্টার। ১৯৯৭ সালে শুরু করে দুই বছর পরপর গবেষণাটি পরিচালনা করে আসছে তারা। করোনার অতিমারির কারণে ২০২০ সালের জরিপটি করা হলো ২০২১–এ। দেশে ১৫ বছর এবং তার চেয়ে বেশি বয়সী মানুষ মোট ১১ কোটি ৫৪ লাখ ৬৭ হাজার। তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে বহুস্তর স্ট্র্যাটিফাইড ক্লাস্টার স্যাম্পলিং পদ্ধতিতে ১৬ হাজার ৮৮৩ জন জরিপে সরাসরি অংশ নিয়েছেন। এনএমএস ২০২১ অনুযায়ী, সারা দেশে এ বয়সী মানুষের মধ্যে ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ নিয়মিত পত্রিকা পড়েন। উল্লেখ করার মতো ১২৯টি পত্রিকা ও ১২২টি ম্যাগাজিন রয়েছে দেশে। এনএমএস অনুযায়ী, সারা দেশে ছাপা কাগজে প্রতিদিন প্রথম আলো পড়েন প্রায় ৫০ লাখ পাঠক।
ক্যান্টার বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আ ন ম জিয়াউল ইসলাম বলেন, ‘এই জরিপের উদ্দেশ্য হলো, বাংলাদেশের মানুষের গণমাধ্যম–সংক্রান্ত আচরণ সম্পর্কে জানা, মানুষ কোন মাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা কী দেখছেন, কী পণ্য ব্যবহার করছেন—সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া।’
এনএমএস ২০২১-এ বয়স, নারী-পুরুষের অনুপাত, শিক্ষা, পেশা, আর্থসামাজিক শ্রেণি, পরিবারের ধরন ও মাসিক আয়ের মতো জনতাত্ত্বিক তথ্যভেদে জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণ করা হয়েছে। প্রচারমাধ্যমের তথ্যের পাশাপাশি ছিল খাবার, গৃহপণ্য, পারসোনাল কেয়ার, শিশুসেবা ও রান্নার মতো ৫০টির বেশি পণ্য এবং হোম অ্যাপ্লায়েন্স, নেটওয়ার্ক ডিভাইস, যানবাহন, ইলেকট্রিক যন্ত্র ইত্যাদির মতো ৪০টির বেশি দীর্ঘ ব্যবহার্য পণ্যের যোগসূত্র ও বাজার গবেষণা বিষয়ে তথ্য।
বাজার গবেষণা নিয়ে বেশ কিছু জরিপ থাকলেও গণমাধ্যম নিয়ে এত দীর্ঘদিন ধরে ধারাবাহিকভাবে পরিচালনা করা জরিপ এটিই। বিশ্বব্যাপী বিস্তার, সুখ্যাতি ও বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতার কারণে লন্ডনভিত্তিক জরিপ পরিচালনা প্রতিষ্ঠান ক্যান্টারের এনএমএসের গ্রহণযোগ্যতা সর্বাগ্রে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যান্টারের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৯২ সালে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ও প্রভাবশালী বহুমাত্রিক বিজ্ঞাপনী সংস্থা ডব্লিওপিপির হাত ধরে। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আর্থিক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বেইন ক্যাপিটাল। বর্তমানে বিশ্বের ৯০টির বেশি দেশে ক্যান্টারের ২৫ হাজার কর্মী কাজ করছেন।
বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘গণমাধ্যমের ভোক্তা–সংক্রান্ত তথ্য এ দেশে একেবারেই অপ্রতুল। এর মধ্যে ক্যান্টারের এনএমএসকেই বলতে হয় উল্লেখযোগ্য। আমরা বিপণন ও বিজ্ঞাপন পরিকল্পনার জন্য এর ওপর বেশ নির্ভর করি। পত্রিকা, টেলিভিশন ও রেডিওর ব্যবহারকারীদের তথ্য নিয়ে কাজ করতে হলে এনএমএসের বিকল্প নেই আমাদের দেশে। অনেক বছর ধরেই বিভিন্ন ব্র্যান্ড এনএমএসকে ভিত্তি ধরে কাজ করছে।’
বাংলাদেশের মতো দেশে পত্রিকা ও টেলিভিশনের মতো প্রচারমাধ্যমের প্রভাব ও বিস্তার এখনো ডিজিটাল মাধ্যমের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রেই বেশি। এ জন্যই অ্যাভাব দ্য লাইন (এটিএল) মাধ্যমগুলোতে বিজ্ঞাপনের বাজেটও সবচেয়ে বেশি। তবে কার্যকর ও সাশ্রয়ী বিজ্ঞাপন পরিকল্পনার জন্য এমন মাধ্যমেও এখন সুনির্দিষ্টভাবে যোগাযোগ করা খুব জরুরি। এ কারণেই এনএমএস খুব জরুরি বলে মনে করেন গ্রে অ্যাডভারটাইজিং ঢাকার ম্যানেজিং পার্টনার ও ক্রিয়েটিভ চিফ সৈয়দ গাউসুল আলম শাওন।
সৈয়দ গাউসুল আলম শাওন বলেন, ‘বিজ্ঞাপনে আমরা মানুষের গল্প বলি। ভোক্তাদের স্বপ্ন দেখাই। সে জন্য ভোক্তাদের চেনা দরকার। ব্র্যান্ড তৈরির জন্য সঠিক মানুষের কাছে সঠিক মাধ্যমে পৌঁছানোর জন্য এ ধরনের সমীক্ষা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
জাবেদ সুলতান: হেড অব ডিজিটাল বিজনেস, প্রথম আলো