বিশ্ব শরণার্থী দিবস আজ

বাংলাদেশে থাকা সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন হবে কবে

মিয়ানমারের অনীহার কারণে রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার অগ্রগতি খুব ধীরে হচ্ছে। ছবি: রয়টার্স
মিয়ানমারের অনীহার কারণে রোহিঙ্গাদের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার অগ্রগতি খুব ধীরে হচ্ছে। ছবি: রয়টার্স

বাংলাদেশে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থানকাল বছর তিনেক হয়ে গেল। একে তো সম্পদ সীমিত, তার ওপর জনবহুল দেশ, এ কারণে বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সাড়ে ১১ লাখ মানুষের অবস্থান অবশ্যই বাড়তি একটি চাপ। তাই তাদের প্রত্যাবাসন খুব জরুরি। কিন্তু মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে না নিতে অনড়। রাশিয়া ও চীনের মতো প্রভাবশালী দেশগুলোর অব্যাহত সমর্থনে এই সাহস দেখাচ্ছে তারা।

এ মুহূর্তে সাত কোটিরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে আশ্রয় নিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা এটাই সবচেয়ে বেশি। বাস্তুচ্যুত মানুষের মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শরণার্থীর সংখ্যা ২ কোটি ৫৯ লাখ। তাদের অর্ধেকের বয়স ১৮ বছরের কম। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে শরণার্থীদের দুই-তৃতীয়াংশের উৎস পাঁচটি দেশ—সিরিয়া, ভেনেজুয়েলা, আফগানিস্তান, দক্ষিণ সুদান ও মিয়ানমার।

আজ ২০ জুন বিশ্ব শরণার্থী দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) প্রকাশ করেছে তাদের বার্ষিক প্রতিবেদন গ্লোবাল ট্রেন্ডস রিপোর্ট। গত বৃহস্পতিবার জেনেভা থেকে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে এসব তথ্য দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, শরণার্থীদের দুর্দশার দ্রুত সমাপ্তির আশাও দিন দিন কমে আসছে। নব্বইয়ের দশকে প্রতিবছর গড়ে ১৫ লাখ মানুষ প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে নিজের দেশে ফিরতে পারতেন। গত দশকে এই সংখ্যা ৩ লাখ ৯০ হাজারে নেমে এসেছে। এ থেকে বোঝা যায়, বাস্তুচ্যুত লোকজনের জন্য টেকসই সমাধান কতটা সংকুচিত হয়ে গেছে।

শরণার্থীদের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে বেশ আলোচিত। প্রায় তিন বছর আগে জাতিগত নিধনের মাধ্যমে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, তা জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। কয়েক দশক ধরে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতা চালালেও ইতিহাসে এই প্রথম আইসিসি আর আইসিজের মতো আদালতে দাঁড়াতে হয়েছে মিয়ানমারকে। আন্তর্জাতিক সমালোচনা, জবাবদিহির জন্য কাঠগড়ায় দাঁড়ানো—এত কিছুর পরও আলোর মুখ দেখছে না রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, অর্থাৎ সমস্যার মূল সমাধান। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে না নিতে মিয়ানমার অনড় থাকার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে চীন ও রাশিয়ার মতো প্রভাবশালী দেশগুলোর অব্যাহত সমর্থন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, কেউ কিন্তু শখ করে উদ্বাস্তু হয় না। সংঘাতের কারণে লোকজন উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। তাই সংঘাতের উৎস বন্ধ করতে হবে। হিংসা-বিদ্বেষ কমাতে হবে। বাংলাদেশ মনে করে, হিংসা-বিদ্বেষ কমানো গেলে শান্তির সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করা যাবে।

বিশ্ব শরণার্থী দিবসের প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী গতকাল শুক্রবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবেশী মিয়ানমার আমাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে রাজি হয়েছে। তাদের বলেছি, রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও মর্যাদার সঙ্গে ফিরিয়ে নিতে হবে। স্বেচ্ছায় তাদের ফিরিয়ে নিতে পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। মিয়ানমার সবকিছুতে রাজি হয়েছে। কিন্তু গত তিন বছরে রাখাইনে কোনো সহায়ক পরিবেশ তৈরি করেনি; বরং করোনার সময় বিশ্বের অন্য সব দেশে অস্ত্র বিরতি চললেও রাখাইনে সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। এ জন্য আমরা দিন দিন আরও হতাশাগ্রস্ত হচ্ছি।’

বাংলাদেশে ২০১৭ সালের আগে থেকে অন্তত লাখ চারেক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছিল। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সেনাচৌকিতে জঙ্গি হামলাকে অজুহাত দেখিয়ে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধন শুরু করে সেনাবাহিনী। এরপর থেকে পরের কয়েক মাসে বাংলাদেশে এসেছে আরও সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে বাংলাদেশে।

বিশ্বজুড়ে শরণার্থী সংকট জটিল হওয়ার বিষয়টির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ ফেলো মো. শহীদুল হক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, শরণার্থী ও বাস্তুচ্যুত লোকজনের সংখ্যা যখন বাড়ছে; একই সময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এ ধরনের জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দিতে যে প্রক্রিয়া তৈরি করা হয়েছিল, তা ভেঙে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ যে দেশগুলো এদের সুরক্ষা প্রদানসহ মানবাধিকার সমুন্নত রাখার ব্যাপারে সামনে থেকেছে, তারা এখন ওই জনগোষ্ঠীর সহায়তায় কর্মসূচি বন্ধ করে দিয়েছে।

ফাইল ছবি

মো. শহীদুল হক আরও বলেন, মূল কথা হচ্ছে, তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে শরণার্থীদের সুরক্ষার প্রক্রিয়াটা বড় ধরনের সমস্যার মুখে পড়েছে। কারও কারও মতে, নতুন উদার বিশ্ব ব্যবস্থার ভিত্তিই ছিল শরণার্থী, অভিবাসী ও বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীদের মানবাধিকার সুরক্ষা। কাজেই সাড়ে সাত কোটি জনগোষ্ঠীকে কীভাবে সুরক্ষা দেওয়া হবে, সেটা এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিগগির এর সুরাহা হবে না। কারণ, যারা এদের সুরক্ষা দিত, তারা পিছু হটেছে। তা ছাড়া বৈশ্বিক অর্থনীতিতে যেহেতু মন্দা দেখা দিয়েছে, তাই পৃথিবীজুড়ে যাদের নাগরিকত্ব নেই, তারাই সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছে এবং পড়বে। উপরন্তু, এদের সহায়তা নিশ্চিত করার জন্য জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা তাদের সঙ্গে সেভাবে যুক্ত থাকতে চাইছে না। একধরনের অনিশ্চয়তায় পড়ে গেল। 

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়টি থমকে যাওয়ার বিষয়ে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই জ্যেষ্ঠ ফেলো বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যায় জবাবদিহির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। কারণ, আইসিজেতে মামলাটা গাম্বিয়া ওআইসির হয়ে করলেও নেপথ্যে মূল ভূমিকাটা রেখেছে বাংলাদেশ। প্রথম থেকেই মিয়ানমার চেয়েছিল, যা কিছুই হোক, তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে না। তাই দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমস্যার সমাধানটা কঠিন হয়ে গেছে। অন্যদের মধ্যস্থতায় এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। তাই বহুপক্ষীয় ফোরামে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। জবাবদিহির মধ্য দিয়েই এর একটা সুরাহার চেষ্টা করতে হবে। এসবের পাশাপাশি দ্বিপক্ষীয় প্রক্রিয়াটা চালু রাখতে হবে। কারণ, আন্তর্জাতিক আদালত আর বহুপক্ষীয় ফোরামে চাপে পড়ে মিয়ানমার আবার দ্বিপক্ষীয় প্রক্রিয়ায় ফিরতে বাধ্য হবে। তবে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার বিষয়টি দ্বিপক্ষীয় একটি সমাধান, যেখানে আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর উপস্থিতি থাকবে। 

আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ায় মিয়ানমার নেপথ্যে চীনকে রেখে ২০১৭ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রত্যাবাসনের চুক্তি সই করেছিল। প্রত্যাবাসনের জন্য পরের বছর সচিব পর্যায়ের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করে কয়েকবার আলোচনাও হয়। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ ইউএনএইচসিআর এবং মিয়ানামার জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও ইউএনএইচসিআরের সঙ্গে চুক্তি করেছিল। জাতিসংঘের দুই সংস্থা মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি করলেও রাখাইনে তাদের অবারিতভাবে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। ফলে, রাখাইনে আদৌ রোহিঙ্গাদের ফেরার পরিবেশ হয়েছে কি না, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল বারবার প্রশ্ন তুলেছে।

এরই মধ্যে ২০১৮ সালের ৩০ নভেম্বর অনেকটা হুট করেই মিয়ানমার ও বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের মতামত ছাড়াই প্রত্যাবাসনের প্রথম দিনক্ষণ ঠিক করে; যদিও ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। 

রোহিঙ্গা সমস্যার প্রশ্ন নিয়ে কার্যত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, আরও স্পষ্ট করে বললে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ জাতিসংঘ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সব সময় উচ্চকণ্ঠ থেকেছে। ঠিক ততটাই মিয়ানমারের পক্ষে জোরালো অবস্থানে রয়েছে চীন ও রাশিয়া। ফলে, আন্তর্জাতিকভাবে প্রবল সমালোচনার পরও মিয়ানামার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে কিছু করেনি। এমন এক পরিস্থিতিতে ২০১৮ সালের মাঝামাঝি থেকে চীন অনেকটা প্রকাশ্যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে আলোচনার টেবিলে বসিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য তোড়জোড় শুরু করে দেয়। এমনকি গত বছর রাখাইনের পরিস্থিতিকে বিবেচনায় না নিয়ে এবং রোহিঙ্গাদের মতামতকে উপেক্ষা করে ১৫ আগস্ট আরও একবার প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ ঠিক করা হয়। শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় দফায় প্রত্যাবাসনের চেষ্টাও ভেস্তে গেছে। এরপর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে নিয়ে আবারও আলোচনা করে একটি ত্রিপক্ষীয় কমিটি করে দেয় চীন।

ঢাকায় চীন ও মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মহাপরিচালকের সুপারিশ অনুযায়ী প্রস্তুতি নেওয়ার কথা ছিল। এখন পর্যন্ত অন্তত চারবার তিন দেশ মিলে আলোচনায় বসলেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। এমনকি চীনের রাষ্ট্রদূতের উদ্যোগে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনের কথা থাকলেও মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত শেষ পর্যন্ত কক্সবাজার যেতে অনীহা দেখান। সব মিলিয়ে দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বাস্তবায়নে যেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি, তেমনি চীনের মধ্যস্থতার উদ্যোগে কোনো আশার আলো দেখছেন না বাংলাদেশের কর্মকর্তারা। 

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বলেন, ‘পরিবর্তিত বাস্তবতায় আজ বলপূর্বক বাস্তুচ্যুতির পরিমাণই যে শুধু বেড়েছে তা নয়, বেশির ক্ষেত্রেই সমস্যাগুলো দীর্ঘমেয়াদি। নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের কিংবা নতুন কোথাও ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার কোনো আশা ছাড়া এই মানুষগুলো বছরের পর বছর কাটিয়ে দিচ্ছে অনিশ্চয়তায়, এটা মেনে নেওয়া যায় না। শরণার্থীদের জন্য প্রয়োজন একেবারে নতুন ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি; এর সঙ্গে সঙ্গে তাদের দুর্ভোগের মূলে থাকা বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা সংঘাতগুলোর সমাধানে চাই দৃঢ় প্রত্যয়।’