শামসুর রাহমান

বাংলাদেশের হৃদয়

শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯—১৭ আগস্ট ২০০৬)
শামসুর রাহমান (২৩ অক্টোবর ১৯২৯—১৭ আগস্ট ২০০৬)

১৯৪৭ সাল। বিভক্ত বঙ্গদেশ। চোখের সামনে তখন স্বপ্ন ও কল্পনার নতুন বসতি—পাকিস্তান। তার আগে কয়েক দশকজুড়ে বাংলা অঞ্চলের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে গেছে দাঙ্গা ও হত্যা। বাতাসে তখনো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বারুদগন্ধ। মসনদ থেকে সরে গেছে ঔপনিবেশিক প্রভু। অভিজ্ঞতার এসব ঝুলি কাঁধে নিয়ে ১৯৫০ সালে পূর্ববঙ্গের একদল তরুণ প্রকাশ করলেন কবিতার সংকলন নতুন কবিতা। কবিদের তালিকায় ছিলেন এমন একজন, পরবর্তীকালে যিনি হয়ে উঠলেন সময়ের ঘোড়সওয়ার; তিনি শামসুর রাহমান—বাংলা কবিতার স্বতন্ত্র এক কাব্যবিশ্ব। বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের এই কবি ছুটেছেন সময়ের সঙ্গে, ইতিহাসের চত্বরে গড়ে তুলেছেন কবিতার মঞ্চ। তাঁর হাতে উত্তোলিত হয়েছে প্রতিরোধের শামিয়ানা। অথচ তাঁর আরম্ভ ছিল বিষণ্ন ও দুঃস্বপ্নের চাদরে মোড়া।

কবিতার সৌন্দর্যে ডুব দিয়ে ১৯৬০ সালে শামসুর রাহমান প্রকাশ করেছেন প্রথম বই প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে। অভাবিত সব চিত্রকল্পের বিন্যাসে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন আত্মমগ্ন তরুণের দিনলিপি। অবশ্য তার আগেই, ১৯৫২ সালে বদলে গিয়েছিল সৌন্দর্যের দৃশ্যপট। ঢাকার রাস্তায় গড়িয়ে পড়েছিল রক্ত। বাঙালি বুঝতে পেরেছিল, এক আধিপত্যের মুঠি ছেড়ে বেরোতে না বেরোতেই তারা ঢুকে পড়েছে আরেক আধিপত্যের কবজায়। ২১ ফেব্রুয়ারির তুমুল আলোড়নে রাহমান লিখলেন ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’। ঊনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে ‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো’ তিনি ওড়ালেন ‘আসাদের শার্ট’।

বাংলা কবিতার মহাফেজখানায় একে একে জায়গা পেল রৌদ্র করোটিতে, বিধ্বস্ত নীলিমা, নিরালোকে দিব্যরথ, নিজবাসভূমে। শামসুর রাহমানের কবিতায় গভীরভাবে যুক্ত হয়ে গেল স্থান, কাল ও ইতিহাসের চিহ্ন, যদিও তাঁর প্রথম কবিতার বই ছিল প্রধানত এক নান্দনিক ভূমি। ধীরে ধীরে এই ভূমির গর্ভ ছেড়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে পূর্ববঙ্গ ও বাংলাদেশ। অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দিলেন তিনি। কবিতায় এল প্রতিদিনকার প্রত্যক্ষ জীবন। শব্দ ও অলংকারের গাঁথুনিতে উঠে এল ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, হতাশা আর মিছিলের কলরোল। কিন্তু ‘সব পেয়েছির দেশ’ ভেবে গড়ে তোলা পাকিস্তানে এসব কেন? বাংলাদেশের ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল অসম বিন্যাস। তারই উপজাত হিসেবে এসেছিল ব্যথাতুর জীবন-আখ্যান।

পূর্ব বাংলার এই প্রেক্ষাপটে শামসুর রাহমান ক্রমশ মোড় নিয়েছেন জাতীয় চেতনার দিকে। তারই এক তীব্রতম প্রকাশ বন্দী শিবির থেকে। প্রশ্নাতীতভাবে বইটিকে গণ্য করা যায় মুক্তিযুদ্ধের কাব্যিক দলিল। এ বইয়ের কবিতাগুলোতে মুদ্রিত আছে তাঁর যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা; খুব গোপনে সতর্কতার সঙ্গে কলকাতার দেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল এ বইয়ের কিছু কবিতা। প্রকাশের সময় কবির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘মজলুম আদিব’, নির্যাতিত লেখক।

কবিকে বলা হয় দ্রষ্টা—যেন তাঁরা ভবিষ্যৎ দেখতে পান। দ্রষ্টার মতো করেই শামসুর রাহমান বলেছিলেন, ‘তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা।’ শ্রেণি–ধর্ম–বর্ণ–লিঙ্গনির্বিশেষে জেগে ওঠা জনতার ভাষাকে পাঠ করতে পেরেছিলেন তিনি। খাণ্ডবদাহন ও রক্তগঙ্গা পেরিয়ে আসা ‘দেশ’ ছিল তাঁর চেতনার শীর্ষ স্তরে। হয়তো তাই, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেও তিনি বিশেষভাবে ‘দেশ’কে বুঝতে চাইলেন; দেখার ভঙ্গি থেকে গেল জাতীয় চেতনার কাঠামোতেই।

এর মধ্যে বদলে গেছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত। সমাজ রূপান্তরের সম্ভাব্য সব পথ রুদ্ধ। ভবিষ্যৎহীন চোরাবালিতে হারিয়ে গেছে দেশ। খুব অল্প সময়ের মধ্যে আপন মানচিত্রে নতুন দেশটি মুখোমুখি হয়েছে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, সামরিক শাসন ও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির। শামসুর রাহমানের চোখ তখনো সময়ের আরশিতে। পেশায় সাংবাদিক ছিলেন বলেই হয়তো ঘটমান বাস্তবতার দিকে তাক করা ছিল তাঁর দৃষ্টি। দেখতে দেখতে অন্য অনেকের মতো আবারও স্বপ্নভঙ্গ হলো তাঁর। ১৯৭৩ সালে কবিতার বইয়ের নাম হয়ে গেল দুঃসময়ে মুখোমুখি। দীর্ঘায়িত দুঃসময়ের ছবি হিসেবে ১৯৮২ সালে আমরা পেলাম উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ। তত দিনে বাংলাদেশ চলে গেছে সামরিকায়নের পথে। কণ্ঠে হাহাকার তুলে শামসুর লিখেছেন, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ বিরানায়; মুক্তিযুদ্ধ/ হায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়।’ সামরিক সরকারবিরোধী আন্দোলনে শহীদ নূর হোসেনের প্রতিচ্ছবি মনে রেখে ১৯৮৮ সালে তিনি লিখলেন, ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’।

কবিতার রংমহলে অন্য একটি জানালাও ছিল তাঁর, যেখান দিয়ে রাহমান আনমনে দেখে নিয়েছেন নিজস্ব আকাশ। রোমান্টিকতার জানালাপথে উড়াল দিতে দিতে তিনি লিখেছিলেন ‘ইকারুসের আকাশ’। গ্রিক পুরাণের ইকারুসকে প্রতিস্থাপিত করেছিলেন বাসনার প্রতীক হিসেবে—সূর্যের উত্তাপে মোম দেওয়া ডানা গলে যাবে জেনেও যে ছিল আকাশবিহারী। কখনো বাস্তবতার ভেতর ঢুকে পড়ে রাহমানের স্বপ্ন, কখনোবা স্বপ্নের ভেতর অনুপ্রবেশ করে বাস্তবতা। রোমান্টিকের এই চপল দ্বিধার দেখা মিলবে তাঁর ‘হোমারের স্বপ্নময় হাত’-এ। শহুরে কবির মধ্যবিত্ত মন মাঝেমধ্যেই আড়াল খুঁজেছে নির্জন ছায়ায়। পরিণত পর্বে এ ছায়ার অন্য একটি নাম দিয়েছেন তিনি, ‘মেঘলোকে মনোজ নিবাস’।

শামসুর রাহমান কবিতাকে করে তুলেছিলেন দৈনন্দিন ভাষার সমাহার। উপমা-চিত্রকল্পঘেরা চিত্রল দৃশ্যের সমান্তরালে সেখানে জায়গা পেয়েছে কথ্য বাংলার সংলাপ। আলাপি মানুষের কণ্ঠস্বর ও স্বরপ্রক্ষেপ তাঁর কবিতাকে করেছে সজীব শিল্পকলা। প্রকৃতপক্ষে তিনি হাজির করতে চেয়েছেন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতার বহুস্বর। বাংলাদেশের কবিতার জন্য এই আয়োজন ছিল অভিনব ও প্রভাববিস্তারী। ষাট ও সত্তরের দশকের অনেক নবীন কবি মাড়িয়ে গিয়েছেন এই পথ। কিন্তু ‘রাহমানীয়’ ভাষা ও ভঙ্গির কাছে পরাস্ত হয়েছেন।

অবশ্য রাহমানের বিশেষত্বের পাশাপাশি এ–ও স্বীকার করতে হবে যে পঞ্চাশের দশকের স্বভাব মেনে আধুনিকতাবাদী সাহিত্য ও শিল্পকলার সঙ্গে তাঁর প্রথাসিদ্ধ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। শার্ল বোদলেয়ার, টি এস এলিয়টের কবিতা তাঁকে দিয়েছিল নতুন প্রণোদনা। এ ধরনের সাহিত্যের বড় অংশই ছিল অবক্ষয়ী চিন্তা এবং বিচ্ছিন্নতায় আচ্ছন্ন। সময় ও ইতিহাসকে উপেক্ষা করার ঝোঁক ছিল আধুনিকতাবাদী শিল্পকলার। এসবের আংশিক প্রভাব সত্ত্বেও শামসুর রাহমান ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন শুদ্ধ শিল্পের উল্টো পথে। বাস্তবতার সংলগ্ন হয়ে তিনি দেখেছেন পার্কের নিঃসঙ্গ খঞ্জ, খেলনার দোকানের সামনের ভিখিরি, রাতের নিয়ন, দোকান, বিজ্ঞাপন, মাতাল, বেশ্যা। তাঁর কবিতা বাস্তবতার এমনই এক সাংস্কৃতিক দলিল, যার সূত্রে আবারও নির্মিত হতে পারে পুরোনো ঢাকা; এমনকি বিনির্মিত হতে পারে শহর ঢাকার নগরায়ণের ইতিহাস। কিন্তু কী কারণে শামসুর রাহমান বাঙালি সংস্কৃতির কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন? এককথায় এর জবাব হলো জাতীয়তাবাদ।

বাঙালিমাত্র শামসুর রাহমানকে আত্মস্থ করেছে জাতীয় চেতনার আধার ও আধেয় হিসেবে। কেননা, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বাঁকবদলগুলোতে তিনি সরব থেকেছেন। কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের কাছে সমর্পিত না হয়ে তিনি জারি রেখেছেন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধ। এখানেই রাহমান সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক। বলাবাহুল্য এই প্রতিরোধ বৈপ্লবিক নয়, বরং উদার মানবিকতাবাদী অবস্থান থেকে ছুঁয়ে দেখেছেন দেশের মর্মস্থল। বাংলাদেশের হৃদয় থেকে উত্থিত তাঁর উচ্চারণ। আর তাই ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়েছে তাঁর কবিতা। বাংলাদেশের সভা-সমিতি-মঞ্চে প্রতিনিয়ত উচ্চারিত হয়েছে তাঁর অসংখ্য পঙ্‌ক্তি। আমাদের মনে পড়বে উপনিবেশিত আফ্রিকার লিওপোল্ড সেদর সেঙ্ঘর, চিলির পাবলো নেরুদা, ফিলিস্তিনের মাহমুদ দারবিশের মতো কবিরাও রাজনীতির মঞ্চ কাঁপিয়ে বুঝে নিতে চেয়েছিলেন দেশ ও জাতির জমিন।

জনরুচি ও সমকালীন বাস্তবতার সঙ্গে কবিতার সেতুবন্ধ অনেক সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। আধুনিকতাবাদী কবিরা সে ঝুঁকি কমই গ্রহণ করেছেন। সে সূত্রে কেউ কেউ মনে করেন, কবিতার শিল্পত্ব ও অমরত্বে প্রধান অন্তরায় হলো রাজনীতি। অমরত্বের খোপে বন্দী হতে গিয়ে শামসুর রাহমান দুর্বোধ্যতার দুর্গে কবিতাকে আটকে ফেলেননি, বরং কবিতাকে নিয়ে যেতে চেয়েছেন শিল্পের অতিরিক্ত অনুশাসন ও শৃঙ্খলার বাইরে; যেখানে বিস্ফোরিত হওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ জনতার বিক্ষুব্ধ মন।

সাম্প্রতিক বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হয়তো অনুমান করাও সম্ভবপর নয় যে পঞ্চাশ থেকে নব্বইয়ের দশকের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় কী প্রবল উদ্দীপনা জোগাতেন শামসুর রাহমান। জাতীয় পরিচয়, গণতন্ত্র ও সম্প্রদায়নিরপেক্ষ সাংস্কৃতিক রাজনীতির বড় একটি উৎস তাঁর রচনাবলি। তাঁর কবিতায় কান পাতলে শোনা যায় বাংলাদেশের জন্ম ও বিকাশের বৃত্তান্ত, একই সঙ্গে শোনা যায় স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের বয়ান। আর তাই অনায়াসে বলা যায়, বাঙালির লড়াই-সংগ্রামের মহাকাব্যিক বৃত্তান্তে সময় ও ইতিহাসের কথক তিনি; তাঁরও বুক বহন করে চলে ‘বাংলাদেশের হৃদয়’।

সুমন সাজ্জাদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক