বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষার জন্য কী করব

একুশে ফেব্রুয়ারি
ফাইল ছবি

করোনা অতিমারিতে পৃথিবী আক্রান্ত হওয়ার ঠিক আগের বছরটি, ২০১৯ সাল, ছিল ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষাবর্ষ’। জাতিসংঘ স্বীকৃত আন্তর্জাতিক বর্ষ হিসেবে প্রায় ৭৮টি দেশে দিবসটি পালিত হয়। পৃথিবীর বিপন্নপ্রায় নৃতাত্ত্বিক ভাষাগুলোর সংরক্ষণ, প্রসার ও উন্নয়ন বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যেই বর্ষটি পালনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল।

২০১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ২০২২-৩২ সময়কালকে ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষা দশক’ পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিপন্ন ভাষাগুলোকে টিকিয়ে রাখা, তাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনের স্বাতন্ত্র্যকে সমুন্নত রাখা এবং জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সবার সমান ভাষিক অধিকার নিশ্চিত করা। প্রশ্ন হচ্ছে, ২০২১ সালের বর্তমান বাস্তবতায় বাংলাদেশ তার ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর জন্য কতটা প্রস্তুত?

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর ভাষার বর্তমান অবস্থাটা আসলে কেমন? এর উত্তর বেশ জটিল। প্রথমত, সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশে বসবাসরত বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ভাষাগুলোকে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা’ নামে অভিহিত করা হয়। আদিবাসী ভাষা বলা হবে না কেন, তা নিয়ে তাত্ত্বিক বিতর্ক চলে আসছে। দ্বিতীয়ত, একই জাতিগোষ্ঠীর মানুষ একাধিক ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় কথা বলেন। আবার একই ভাষা ব্যবহারকারী ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীও রয়েছে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশে বসবাসরত ৫০টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মোট জনসংখ্যা কত? তাদের মধ্যে শিক্ষার হার কতটা, তা–ও অজানা। ২০১১ সালের সরকারি জনশুমারি এবং সরকারি-বেসরকারি সংক্ষিপ্ত জরিপের তথ্য-উপাত্ত থেকে এখনো আমরা অনুমাননির্ভর সংখ্যা দিয়ে যাচ্ছি।

বর্তমানে দেশে সরকারিভাবে স্বীকৃত ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ৫০টি। এদের মধ্যে প্রায় ৪০টি ভিন্ন ভিন্ন ভাষা প্রচলিত আছে। উল্লেখযোগ্য ভাষাগুলো হচ্ছে চাকমা, সাঁওতাল, তঞ্চঙ্গ্যা, মারমা, মান্দি, ককবোরক, সাদরি, মণিপুরি (মৈতেই ও বিষ্ণুপ্রিয়া), কুডুঁখ, হাজং, কোচ, খাসি, খুমি, খিয়াং, মুণ্ডা, ম্রো, চাক, পাত্র, সৌরা, পাংখোয়া প্রভৃতি। বাংলাদেশের অধিকাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা থাকা সত্ত্বেও এদের প্রায় সবাইকেই দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বাংলা শিখতে হয়।

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষায় সাধারণত তিন ধরনের পরিবর্তন ঘটছে: উচ্চারণগত, শব্দভান্ডারগত এবং অনেকেরই নিজস্ব লিপি না থাকায় লোকসাহিত্য সীমিত হয়ে যাওয়া। যাদের লিপি আছে, তারাও সেটি চর্চার সুযোগ পাচ্ছে না। যেমন চাকমাদের নিজস্ব লিপি আছে, কিন্তু তাদের ৯৫ শতাংশই সেটি লিখতে-পড়তে পারে না। এ কারণে তাদের অধিকাংশ সাহিত্যই রচিত হচ্ছে বাংলা হরফে। অনলাইনেও তারা বাংলা ও রোমান হরফে মাতৃভাষা চর্চা করছেন। জাতিগোষ্ঠীর বয়স্ক মানুষেরা মুখে মুখে প্রচলিত যেসব গল্পগাথা ও লোকজ্ঞান প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিতেন, তার চর্চা দিন দিন কমে যাচ্ছে।

বাংলাদেশে নানা ভাষা ও সংস্কৃতির মানুষ থাকলেও দেশের ৯৭ শতাংশই বাঙালি। জাতিগোষ্ঠীগুলোর ওপরে বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির প্রবল প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক। অবশ্য সরকারি উদ্যোগে পাঁচটি জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে নানা জটিলতায় তা এখনো ফলপ্রসূ হয়নি।

একুশে ফেব্রুয়ারি

বাংলাদেশের জাতিগোষ্ঠীদের লিপি সমস্যাও একটি বড় বিষয়। আগেই বলেছি, অধিকাংশ ভাষার নিজস্ব লিপি নেই। যেগুলোর আছে, প্রচলনের স্বল্পতায় সেগুলো গ্রহণযোগ্য চর্চার উপযোগী হয়ে উঠতে পারেনি। কেউ রোমান, কেউবা বাংলা লিপি গ্রহণ করেছে। ম্রো এবং চাকরা নিজস্ব একটা লিপি তৈরি করেছে। তবে তা কতটা ভাষাবিজ্ঞানসম্মত, আমরা জানি না। উত্তরবঙ্গ অর্থাৎ রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুর, বগুড়া, রংপুর, ঠাকুরগাঁ প্রভৃতি অঞ্চলে দুই লক্ষাধিক সাঁওতাল বসবাস করে। বাংলাদেশে সাঁওতালি ভাষায় বাংলা ও রোমান উভয় লিপিই ব্যবহৃত হয়। লিপি সমস্যার কারণে তাদের মাতৃভাষায় পাঠ্যবই হয়নি। একটি সর্বজনসম্মত লিপি নির্ধারণ করা গেলে তারা মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ পেত।

বাংলাদেশের বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কতগুলো সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। সরকারি পর্যায়ে একটি ভাষা কমিশন গঠন করা এবং দীর্ঘ মেয়াদে ভাষাগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া এখন জরুরি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট এ কাজটি করতে পারে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটকে এখনো আসলে আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। এটিকে সক্রিয় করতে পারলে বাংলাদেশের জাতিগোষ্ঠীদের ভাষা সমস্যার অনেকগুলোর সমাধান সম্ভব হতো।

আমাদের পাশে দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশেই একটি ভাষা কমিশন সার্বিকভাবে দেশের ভাষা পরিকল্পনার কাজটি করে থাকে। তারা দেশের ভাষাগুলোর অবস্থা বুঝে সেটি নিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব পালন করে। এমন একটি কমিশন গঠন করা হলে সেটি প্রচলিত জাতিগোষ্ঠীদের ভাষা সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি বাংলা ভাষার সামগ্রিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখতে পারবে। ভাষা সংরক্ষণ বা ল্যাংগুয়েজ ডকুমেন্টেশনের আওতায় দেশে প্রচলিত ভাষাগুলোর ভাষিক ব্যাকরণ রচনা, শব্দকোষ তৈরি করা, সেগুলোর আর্কাইভিং, অনলাইন ও অফলাইনে সে আর্কাইভের সর্বজনোপযোগী ব্যবহার এবং দীর্ঘমেয়াদি মাঠপর্যায়ের ভাষাবৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে সেটি নিয়মিত উন্নত করে তোলা খুবই বাস্তবসম্মত চাওয়া।

বাংলাদেশ ভাষাবৈচিত্র্যে ভরা একটি দেশ। ভাষার দাবিতে রক্ত দেওয়া এই জাতিকে সব ভাষার সমান মর্যাদা দিয়ে ভাষাভাষীদের চর্চার সুযোগ করে দেওয়া কর্তব্য। ভাষার মাস ফেব্রুয়ারিতেই শুধু নয়, আসন্ন আন্তর্জাতিক আদিবাসী ভাষা দশকের সঙ্গে আমরা যেন আন্তরিকভাবে যুক্ত হই এবং কার্যকরী কিছু পদক্ষেপ নিই।

ভাষাশহীদ দিবস থেকে আজকের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের আন্তর্জাতিকতায় আমরা উচ্ছ্বসিত। আমাদের মহান একুশের চেতনায় সব ভাষার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং তা রক্ষা করার একটা দাবি আছে। সে দাবিতে সাড়া দেওয়ার জন্য সরকার ও নাগরিক সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।