জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বাংলাদেশের আবাসিক প্রতিনিধি সুদীপ্ত মুখার্জি কথা বলেছেন বাংলাদেশে নারী উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।
প্রথম আলো: পাঁচ বছর ধরে আপনি বাংলাদেশে কাজ করছেন। এখানে নারীর অগ্রগতির ক্ষেত্রে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
সুদীপ্ত মুখার্জি: নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি যদি পরিসংখ্যানের দিক থেকে দেখি, তাহলে আমি বলব, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান অনেক ভালো। আমি ২০১৬ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশে এসেছিলাম, এখন ২০২২ সালের প্রায় অর্ধেক পেরিয়ে গেছে। এ সময়কালে বাংলাদেশের নারীরা অনেক এগিয়েছেন, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পশ্চাদগমন হয়েছে। আমার তো মনে হয়, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ আরও বেশি এগিয়ে যেতে পারত, বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাচ্ছে। এটা আসলে অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে যাওয়া নয়, এটা বাংলাদেশের নিজের তুলনায় পিছিয়ে যাওয়া।
কোভিড-১৯ কি নারীর অগ্রযাত্রার পথে কোনো বাধা তৈরি করেছে?
সুদীপ্ত মুখার্জি: কোভিড মহামারি বাংলাদেশে নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে বহুমাত্রিকভাবে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক নারী কর্মহীন হয়েছেন। কর্মজীবী অনেক নারীর আয় কমে গেছে। করোনার সময় গৃহে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বেড়ে গিয়েছিল।
তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি হয়েছে, কোভিডকালে বিপুলসংখ্যক মেয়েশিশু স্কুল থেকে ঝরে পড়েছে, যাদের অনেকের বাল্যবিবাহ হয়ে গেছে। এদের সঠিক ডেটা এখনো তৈরি করা সম্ভব হয়নি। সঠিক তথ্য জোগাড় করে সব মেয়েশিশুকে স্কুলে ফিরিয়ে আনতে হবে। এমনকি যারা বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে, তাদেরও স্কুলে ফিরিয়ে আনা জরুরি। এ জন্য প্রচুর অ্যাডভোকেসির প্রয়োজন, যার জন্য ইউনিসেফ, ইউএনএফপিএ, ইউএনডিপি, ইউএনউইমেন—সবাই মিলে আমরা কাজ করছি। আমরা চেষ্টা করছি মেয়েদের স্কুলে ফেরানোর বিষয়ে বড় ক্যাম্পেইন করতে। বাল্যবিবাহ কমানোর জন্য কিছু সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। এটি সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। এর পাশাপাশি আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করাও জরুরি।
বিগত বছরগুলোতে সব ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিসিএস, পুলিশ বাহিনী, ব্যাংক-বিমা, চিকিৎসা, শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে নারীরা ভালো করছেন। শ্রমবাজারে নারীর অগ্রগতি তো দৃশ্যমান। এটিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
সুদীপ্ত মুখার্জি: বাংলাদেশে শ্রমবাজারের বিষয়ে বললে প্রথমেই তৈরি পোশাকশিল্পের কথা বলতে হয়। এ খাতে প্রায় ৪০ লাখ পোশাকশ্রমিকের ৬০ শতাংশই নারী। তবে একদিকে এ শিল্পের আকার বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে এখানে নারীর অংশগ্রহণ কিন্তু কমে আসছে। এর দুটি কারণ আছে। প্রথমটি হচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ফলে অনেক যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হচ্ছে। ফলে সারা বিশ্বেই মোট শ্রমশক্তির চাহিদা কমে যাচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রির আকার বাড়ছে অনেকটা কর্মহীনভাবে বা নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ছাড়াই। একে আমরা বলছি, জবলেস গ্রোথ। এ ক্ষেত্রে শ্রমবাজারে নারীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বেশি। দ্বিতীয়ত, যেসব শিল্পকারখানার আধুনিকায়ন হচ্ছে, তৈরি পোশাক খাত তার মধ্যে অন্যতম। তাই নতুন প্রযুক্তির সঙ্গেও নারীকে খাপ খাওয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তাঁর দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে নারীর ক্ষমতায়ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে আমাদের সামনে বাধাগুলো কী।
সুদীপ্ত মুখার্জি: মূল বাধা সামাজিক। অনেক ক্ষেত্রে নেতিবাচকভাবে সামাজিক নিয়মনীতির রূপান্তর ঘটছে। নারীরা আয়মূলক কাজ করতে চান। কিন্তু ঢাকার বাইরে থেকে যখন কোনো নারী একাকী ঢাকা শহরে আসেন, তখন তাঁরা থাকার জন্য ভালো ও নিরাপদ জায়গা পান না। তা ছাড়া গণপরিবহন ব্যবস্থাও নারীবান্ধব নয়। আমি এটাও শুনেছি যে কোনো নারী একাকী থাকতে চাইলে বাড়ির মালিকেরা তাঁকে বাসা ভাড়া দিতে চান না।
বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে নারীবিদ্বেষী প্রচারণা ভীষণ বড় আকারে হচ্ছে। নারীর বিরুদ্ধে ট্রলিং বেশ বেড়েছে। এসব চলতে থাকলে নারীর অগ্রগতির পথ সংকুচিত হতে বাধ্য। নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়ে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার পাশাপাশি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাও নিতে হবে।
গত পাঁচ বছরে জনপরিসরে অনেক ক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে। এটা বাংলাদেশের জন্য একটা আশঙ্কার বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, সরকার বিষয়টি অনুধাবন করছে যে এটি প্রতিরোধ করতে হবে। সাইবার বুলিংয়ের বিরুদ্ধে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ইউএনডিপিও এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে।
সামাজিক রূপান্তরের বিষয়টি সাংস্কৃতিক, যা স্বল্প সময়ের মধ্যে করা সম্ভব নয়। যেসব জায়গায় সামাজিক রূপান্তর প্রয়োজন, শিক্ষা তার মধ্যে অন্যতম। বিশেষ করে ছোটবেলা থেকেই বৈষম্যের ধারণা পরিষ্কার করা উচিত। বাংলাদেশে জেন্ডার সমতা বাড়ানোর জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
এবার প্রযুক্তি খাতের কথায় আসা যাক। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ হিসেবে আমরা অনেক এগিয়েছে। এ অগ্রযাত্রায় নারীরাও শামিল হয়েছেন। ইউএনডিপি ‘আনন্দমেলা’ নামে একটি অনলাইন কার্যক্রম শুরু করেছেন। কেন এই উদ্যোগ?
সুদীপ্ত মুখার্জি: এটি নারী উদ্যোক্তাদের একটা অনলাইন মার্কেটপ্লেস। আমি কোভিড মহামারির শুরুতে একটি বেসরকারি প্ল্যাটফর্ম দাঁড় করাতে চেয়েছিলাম। ২০২০ সালে কোভিডকালের শুরুতে অর্থনৈতিক খাত খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পয়লা বৈশাখ ও ঈদ উৎসব সবাই মিস করে ফেলেছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা যাঁরা এই দিবসগুলোকে কেন্দ্র করে পণ্য উৎপাদন করেন, আয় করেন, তাঁদের কী অবস্থা, তা আমি বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। তখন চিন্তা করলাম, আমরা নারীদের জন্য কোনো অনলাইন মার্কেটপ্লেস করতে পারি কি না। এভাবেই এ উদ্যোগের শুরু। নাম দেওয়া হলো ‘আনন্দমেলা’।
আনন্দমেলা প্রকল্পের পুরো সেটআপ তৈরিতে প্রথম যে তিন হাজার ডলার খরচ হয়, তা আমি নিজের পকেট থেকে দিয়েছিলাম। মাননীয় স্পিকারকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি উদ্বোধন করতে রাজি হবেন কি না। তিনি সানন্দে রাজি হলেন। তাঁকে দিয়ে আমরা উদ্বোধন করিয়েছিলাম। এভাবে আনন্দমেলা অনলাইন মার্কেটপ্লেসের যাত্রা শুরু হয়েছিল।
এ ক্ষেত্রে আপনারা কী কী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলেন?
সুদীপ্ত মুখার্জি: নারী উদ্যোক্তাদের স্মার্টফোনের অভাব ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা দেখলাম, তাঁদের যদি স্মার্টফোন না দিতে পারি, তাহলে কিন্তু তাঁরা সংযুক্ত হতে পারছেন না। আমরা সহকর্মীরা সবাই একমত হয়ে তাঁদের মুঠোফোন কিনে দিয়েছি। সে সময় ২০০ নারী উদ্যোক্তা, যাঁরা দরিদ্র, তাঁদের স্মার্টফোন দেওয়া হয়েছিল। এরপর আমরা উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম, যাতে তাঁরা পণ্যের ছবি তুলতে ও পোস্ট করতে পারেন। এখন প্রায় পাঁচ হাজার এ রকম ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা এই প্ল্যাটফর্মে যুক্ত আছেন।
সম্প্রতি আমরা সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে ঢাকা বিমানবন্দরের টার্মিনালে স্থায়ীভাবে একটি ‘আনন্দমেলা স্টল’ করা যায় কি না, তা ভাবছি। সেখান থেকে বিদেশিরা বাংলাদেশের স্থানীয় পণ্য কিনতে পারবে এবং ধারণা পাবে। এটি কিন্তু সামাজিক কারণে দেওয়া যেতে পারে। এতে বাংলাদেশি পণ্য বিক্রি সম্ভব হবে, আবার নারী উদ্যোক্তারা উৎসাহিত হবেন।
নারী উদ্যোক্তাদের যদি ঋণের প্রয়োজন হয়, তাঁরা কি তা পাচ্ছেন?
সুদীপ্ত মুখার্জি: একজন উদ্যোক্তার যদি গ্যারান্টার না থাকে, তাহলে তিনি ঋণ পাচ্ছেন না। এটি একটি বড় সংকট। আমরা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ইউনিক বিজনেস আইডি তৈরি করার চেষ্টা করছি। বিজনেস আইডেনটিটি থাকার কারণে তিনি একজন ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবেন। তাঁর একটা ক্রেডিট হিস্ট্রি তৈরি হবে। এই তথ্যের ভিত্তিতে তিনি ঋণ পেতে পারবেন।
ঋণ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আপনারা কি কোনো সাপোর্ট দিচ্ছেন?
সুদীপ্ত মুখার্জি: আমরা ইউএনডিপি থেকে নানা রকম প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, যাতে তাঁরা নিয়ম মেনে ঋণের আবেদন করতে পারেন, তাঁদের যেন আর্থিক অন্তর্ভুক্তি হয়।
অনেক কর্মজীবী নারী চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন আবাসন সমস্যা ও দিবাযত্ন কেন্দ্রের অভাবে। এ দুটি ক্ষেত্রে ইউএনডিপি সরকারকে যৌথভাবে সাপোর্ট দিতে পারেন কি না?
সুদীপ্ত মুখার্জি: দিবাযত্ন কেন্দ্রে আমরা অবশ্যই সহায়তা করতে পারি। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে ৭ শতাংশ নারী আছেন। তাঁদের কাজের সুবিধার জন্য আরও শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র দরকার। এ ক্ষেত্রে আমরা একটি মডেল উদ্যোগ নিতে চাইছি, যেখানে নারী কর্মকর্তারা রাতে ডিউটি পালনকালে তাঁদের সন্তানকে নিরাপদে রেখে যেতে পারেন। আমার মনে হয়, এ দেশে যদি ভালো আইডিয়া দেওয়া হয়, তার জন্য কিন্তু টাকার অভাব হয় না। আমরা যদি এটি সফলভাবে করে দেখাতে পারি, তাহলে দেখা যাবে, বাংলাদেশ পুলিশই উদ্যোগ নেবে আরও কেন্দ্র খোলার জন্য।
কর্মজীবী বা একাকী নারীর আবাসন বিষয়ে আপনাদের কী ভাবনা?
সুদীপ্ত মুখার্জি: আমি মনে করি, নারীদের একা অবস্থানের জন্য হোস্টেল-সুবিধা বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) করা প্রয়োজন। এখানে বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা রাজি হবেন। কারণ, নারীরা এখানে টাকা দিয়ে থাকবেন, যদি নিরাপদ ও তাঁদের সামর্থ্যের মধ্যে হয়। আমাদের এমন অনেক বিনিয়োগকারী আছেন, যাঁরা সামাজিক খাতে বিনিয়োগ করতে চান। এ ক্ষেত্রে সরকারকে হয়তো জমি দিতে হবে। সরকার ১২৫টির মতো ইকোনমিক জোন করেছে। এসব ইকোনমিক জোনে কেন নারী হোস্টেল থাকবে না? আমরা যদি ওখানে নারীকে ভালো চাকরি দিয়ে নিয়ে আসতে চাই, তাহলে হোস্টেল করব না কেন? বড় শহরগুলোতে এ রকম হোস্টেলের চাহিদা ও প্রয়োজন রয়েছে।
শুরুতে একটি গবেষণা প্রয়োজন। যেমন একটা নারী হোস্টেল করা হলে কী ধরনের নারীরা থাকতে আসবেন, তাঁরা কত টাকা দিয়ে থাকতে রাজি হবেন ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে অর্থায়ন করা হবে ইউএনডিপির পক্ষ থেকে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার শেষ কথা কী হবে?
সুদীপ্ত মুখার্জি: আমি সাড়ে পাঁচ বছর বাংলাদেশে আছি। এ সময় আমি আমার নিজের দেশের মতোই ভালোবাসা ও আগ্রহ দিয়ে বাংলাদেশকে দেখার চেষ্টা করেছি। আমি আশাবাদী মানুষ। আমি বাংলাদেশের নারীদের সম্ভাবনা অপার দেখি। এ জন্য চাই সঠিক পরিকল্পনা। আমার মতে, নারীর ক্ষমতায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন। আমার মনে হয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে যথেষ্ট পরিমাণ নারীর উপস্থিতি নেই। ৫৪ জন মন্ত্রীর মধ্যে ৫ জন হচ্ছেন নারী। এখানে কিন্তু পরিবর্তন আসা উচিত। রাজনীতিতে তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। রাজনীতিতে তরুণ নারীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। নারীরা বেশি মাত্রায় এলে রাজনীতি ও দেশের ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
প্রথম আলো: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সুদীপ্ত মুখার্জি: প্রথম আলোর পাঠকদের ধন্যবাদ।