বাংলাদেশের অভ্যুদয়: বিদেশি লেখকদের বিবেচনা

মুক্তিযুদ্ধের সময়ই নানা দেশের কবিরা বাঙালির পক্ষে কলম ধরেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলে বিদেশি গবেষকেরাও এ ঘটনার দিকে না তাকিয়ে পারেননি। প্রথমে ভারতের, পরে পশ্চিমা দেশগুলোর। মুক্তিযুদ্ধের নানা পর্ব নিয়ে তাঁদের বিবেচনা।

প্রচ্ছদ: কয়েকটি ভয়ার্ত মুখ। একাত্তরে অাঁকা শিল্পী রশিদ চৌধুরীর চিত্রকর্ম।
প্রচ্ছদ: কয়েকটি ভয়ার্ত মুখ। একাত্তরে অাঁকা শিল্পী রশিদ চৌধুরীর চিত্রকর্ম।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষে আমরা প্রত্যাশা করি বিভিন্নভাবে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে ইতিহাসের ওপর ঘটবে আলোকপাত, উদ্‌ঘাটিত হবে নতুন নতুন তথ্য এবং সেই আলোয় স্নাত হবে ইতিহাসের পুনর্বিচার। এমনি বিবেচনায় এটা আনন্দবহ যে বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহ সাম্প্রতিক কালে বিশেষ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের যাঁরা প্রত্যক্ষদর্শী, তাঁদের মধ্যে কেউ স্মৃতিকথা লিখেছেন, নবীন প্রজন্মের গবেষকদের কেউ কেউ বাংলাদেশ সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে অনুসন্ধানী গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন। এই প্রবণতা সদর্থক বটে এবং একই সঙ্গে আমাদের আশাবাদী করে যে ভবিষ্যতে আরও অনেক বিদেশি গবেষকের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ঘটনাবলি নতুন আলোকে বিচার-বিবেচনায় আমরা সক্ষম হব।

পাশাপাশি জাতীয়ভাবে ইংরেজি বা অন্য ভাষায় ইতিহাসের তথ্যমূলক ও তত্ত্বমূলক গ্রন্থ রচনায় যে ঘাটতি আমরা লক্ষ করি, তা পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে জাতীয় ইতিহাস নিয়ে আমাদের দ্বারা বিদেশি ভাষায় গ্রন্থ রচনার যে গুরুত্ব, তা সম্যক উপলব্ধি করা গেছে বলে মনে হয় না। নিজস্ব ইতিহাস নিজেদের জবানিতে বৃহত্তর পরিসরে পেশ করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ভাষা অবলম্বন ছাড়া গত্যন্তর নেই। এ ক্ষেত্রে আমরা এখনো ভিনভাষী উপযুক্ত জ্ঞানভান্ডার তৈরি করতে পারিনি।

প্রায় দুই দশক আগে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত সভায় যোগ দিয়ে এর গুরুত্ব তুলে ধরেছিলেন চিন্তাবিদ আশিস নন্দী। তিনি বলেছিলেন যে এখন থেকে পরিকল্পনা নিয়ে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের অভ্যুদয়–বিষয়ক অন্তত কুড়িটি মানসম্পন্ন পিএইচডি থিসিস ইংরেজিতে প্রণীত হওয়া দরকার, যেন জ্ঞানচর্চার বিশ্বপরিসরে স্বাদেশিক কণ্ঠও শ্রুত হতে পারে। আমরা তা করতে পেরেছি বলে মনে হয় না।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমরা উল্লেখযোগ্য কিছু অর্জন করতে পারিনি। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পরিসরে ইংরেজি ভাষায় সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রকাশিত গ্রন্থরাজির সঙ্গে আমাদের পরিচিতি যেমন প্রয়োজন, তেমনি পর্যালোচনামূলক দৃষ্টিতে তার বিচারও কাম্য। সুবর্ণজয়ন্তীর বর্ষে ইতিবাচক উপাদান হিসেবে পূর্বাপর আমরা বেশ কতক গ্রন্থ পেয়েছি, যা ইতিহাস অধ্যয়ন কিংবা ইতিহাস-উপলব্ধিতে অন্যতর মাত্রা যোগ করেছে। হালফিল প্রকাশিত দুটি গ্রন্থের উল্লেখ এখানে করা যেতে পারে। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের স্নাতক স্যামুয়েল জাফি যে-বাংলাদেশের ইতিহাস বিষয়ে আগ্রহ বোধ করেছেন এবং তিন বছরের শ্রমের ফসল হিসেবে আমাদের উপহার দিয়েছেন নতুন গ্রন্থ অ্যান ইন্টারনাল ম্যাটার, তা আনন্দসংবাদ বটে। ঢাকা থেকে ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড প্রকাশ করেছে এই বই। ১৯৭১ সালে নিক্সন প্রশাসনের কলঙ্কজনক অবস্থান লেখক বিবেচনা করেছেন সেই সময়ে সংহতি আন্দোলনে যুক্ত অনেক কুশীলবের সঙ্গে ভাববিনিময় করে। সেই সঙ্গে বিপুলা তথ্যভান্ডারে ডুব দেওয়া তো রয়েছেই।

অন্যদিকে জলের নিচে পরিচালিত অনন্য লড়াইয়ের পরিচয় পাওয়া যায় বাংলাদেশের নৌ কমান্ডোদের প্রশিক্ষক ভারতীয় নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন এম এন আর সামন্তর স্মৃতিভাষ্য অপারেশন এক্স-এ। দিল্লি থেকে হারপার কলিন্স প্রকাশ করেছে এই বই। ক্রমে ক্রমে ইংরেজি ভাষায় রচিত বাংলাদেশের ইতিহাসকেন্দ্রিক তথ্যভান্ডার প্রসারিত হচ্ছে এবং এই ধারায় আমাদের নিজস্ব ভাষ্য উপযুক্তভাবে যুক্ত করার দিকে এখনই মনোযোগ দেওয়া দরকার। বিদেশি গবেষক পরিচালিত জ্ঞানচর্চার পরিসরে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থকারদের মধ্যে রয়েছেন রিচার্ড সিসোন, লিও রোজ, ভিলেম ফান শেন্ডেল, গ্যারি বাস, শ্রীনাথ রাঘবন, চন্দ্রশেখর দাশগুপ্ত প্রমুখ। এ ছাড়া ফিকশনের মাধ্যমে ইতিহাস পরিক্রমণের কাজ অনেকে করেছেন, সবল–দুর্বল নানা ধরনের সম্ভার তাঁরা নিবেদন করেছেন, সেই নামের তালিকাও দীর্ঘ। সূচনা বোধ করি রবার্ট পেইনের মাধ্যমে হয়েছে, পরে কামিলা শামসি হয়ে তা নানা লেখকের হাত ধরে নানাভাবে প্রবহমান, বাঙালি লেখকের ইংরেজি রচনাও এখানে মিলবে। কথাসাহিত্যের এই ধারার বিচার-বিশ্লেষণও গুরুত্ব বহন করে।

বাংলাদেশের অভ্যুদয়বিষয়ক গবেষণামূলক গ্রন্থের কাতারে বিশেষ স্থান নিয়েছে সিসোন ও রোজ প্রণীত ওয়ার অ্যান্ড সেসেশন: পাকিস্তান, ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ। গবেষণার উচ্চমান লেখকদ্বয় বজায় রেখেছেন, অসংখ্য দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটেছেন, বিশেষভাবে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের নথি এবং সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঘটনাযুক্ত ব্যক্তিদের। তবে লেখকদ্বয়ের দৃষ্টিভঙ্গি মার্কিন প্রশাসনের প্রতি পক্ষপাত থেকে মুক্ত হতে পারেনি। তাঁরা ইন্দিরা গান্ধী ও ইয়াহিয়া খানের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, দুঃখ প্রকাশ করেছেন শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ কিংবা জুলফিকার আলী ভুট্টোর দেখা পেতে পারেননি বলে, কারণ এক দশক পর তাঁরা যখন কাজ শুরু করেছেন, তখন এঁরা কেউ বেঁচে নেই। তবে যে প্রধান কুশীলবের সাক্ষাৎকার তাঁরা নেননি কিংবা নিতে পারেননি, তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্টের তদানীন্তন নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. হেনরি কিসিঞ্জার। এই নিয়ে বিস্ময়করভাবে, তাঁদের কোনো খেদ প্রকাশ পায়নি। সিসোন ও রোজের গ্রন্থ শিরোনাম থেকে বোঝা যায়, যুদ্ধ থেকে যে-বাংলাদেশের জন্ম তাঁদের কাছে সেটা অভ্যুদয় নয়, ‘বিচ্ছিন্নতা’ হিসেবে গণ্য। আর তাই আন্তর্জাতিক, বিশেষভাবে মার্কিনি কূটনীতিক অবস্থানের ওপরই মূলত দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল তাঁদের। বাংলাদেশের অবস্থান সেখানে গৌণ, এমনকি তৎকালীন কূটনৈতিক ঘটনাধারায় ঢাকাস্থ মার্কিন কনসাল আর্চার ব্লাডের কোনো উল্লেখ নেই গ্রন্থে, নেই বাংলাদেশে সংঘটিত জেনোসাইডের সামান্যতম বিবেচনা।

সিসোন ও রোজের গ্রন্থের ঘাটতি বড়ভাবে পূরণ করেছেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গ্যারি জে বাস। ২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর শ্রমসাধ্য কাজ দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম: নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড দ্য ফরগটেন জেনোসাইড। মার্কিন মহাফেজখানা তো বটেই, তা ছাড়াও গ্যারি বাস ঘেঁটেছেন নিক্সন পেপার্স এবং অবমুক্ত করা হেনরি কিসিঞ্জারের ব্যক্তিগত নথিপত্র। তবে এ ক্ষেত্রেও গ্রন্থকারের সীমাবদ্ধতা ছিল, তিনি জানিয়েছেন কিছু কাগজ হেনরি কিসিঞ্জার রেখে দিয়েছেন, তাঁর মৃত্যুর আগে সেসব প্রকাশ করা যাবে না বলে তিনি ঘোষণা করেছেন। লক্ষণীয়, গ্যারি বাস বহু ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নিলেও হেনরি কিসিঞ্জার গবেষককে সাক্ষাৎকার দেননি, বস্তুত বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ভদ্রলোক কারও সঙ্গে কোনো কথা বলতে নারাজ। তিনি নারাজ যে পাপবোধ থেকে, সেটা আমরা বুঝতে পারি ক্রিস্টোফার হিচেন্স-এর দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার গ্রন্থ পাঠ করলে। কিসিঞ্জার-কৃত আন্তর্জাতিক অনেক অপরাধের অভিযোগ তুলেছিলেন ক্রিস্টোফার হিচেন্স, তবে তথ্যপ্রমাণ হাজির করলেন গ্যারি বাস এবং গণহত্যার সঙ্গে যোগসাজশের জন্য নিক্সন-কিসিঞ্জারকে কোনোভাবে অভিযুক্ত করলে অজস্র দলিল মিলবে গ্যারি বাসের গ্রন্থে।

এই গ্রন্থ রচনায় আর্চার ব্লাডের স্নেহভাজন বাংলাদেশের শহিদুল হক গুল্লুর ভূমিকা উল্লেখ দাবি করে। গ্যারি বাস সেই সহায়তার স্বীকৃতি দিয়েছেন। ট্রাস্টি তারিক আলীকে প্রেরিত পত্রে গ্যারি বাস মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পরিদর্শন এবং প্রাপ্ত সহায়তার কথা বিশেষভাবে স্মরণ করেছেন। প্রকাশনার এক দুর্ভাগ্যজনক দিক হলো ভারত থেকে প্রকাশিত গ্রন্থের এশীয় সংস্করণে উপশিরোনাম পাল্টে দিয়ে মুছে ফেলা হয়েছে নিক্সন-কিসিঞ্জারের নাম কিংবা গণহত্যার উল্লেখ, লেখা হয়েছে ব্লাড টেলিগ্রাম: ইন্ডিয়াস সিক্রেট ওয়ার ইন বাংলাদেশ। ব্লাড টেলিগ্রামসমূহের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সহায়তার তো দূরসম্পর্কও নেই, তাহলে এমন অদ্ভুতভাবে নাম পরিবর্তন কেন? বর্তমান প্রবন্ধকারের জিজ্ঞাসার জবাবে লেখক জানিয়েছিলেন যে তাঁর এতে কোনো হাত বা সায় ছিল না, প্রকাশক এককভাবে এমন কাজ করেছেন। বাজারের দিকে তাকিয়ে জ্ঞানচর্চাকে পণ্য করে মোড়ক কীভাবে বদলে দেওয়া হয়, এটা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে রইল।

পর্দার অন্তরালের ইতিহাস মেলে ধরার আরেক মৌলিক কাজ করেছেন শ্রীনাথ রাঘবন, এশীয় অঞ্চলের রাজনৈতিক ইতিহাস যাঁর অধ্যয়নের বিষয়। রাঘবনও শ্রমসাধ্য কাজ করেছেন, নথিপত্র যেমন ঘেঁটেছেন, তেমনি কুশীলবদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তাঁর গ্রন্থে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান বিশেষ জায়গা নিয়েছে। রাজনৈতিক সংঘাতের পটভূমিকায় সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের অবস্থান ব্যাখ্যায় ব্রতী হয়েছেন শ্রীনাথ রাঘবন, যা অনেক বইয়ে দৃষ্টিগোচর হয় না। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের তাৎপর্য তিনি বৃহত্তর পরিসরে বিবেচনায় নিতে সক্ষম হয়েছিলেন, লিখেছিলেন, ‘হিস্টরি অব দ্য নাইন্টিন সেভেন্টি ওয়ান ক্রাইসিস ইজ নট মেয়ারলি আ ন্যারেটিভ অব দ্য পাস্ট বাট আ ট্র্যাক্ট অব আওয়ার টাইমস।’

আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভিলেম ফান শেন্ডেল দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে কাজ করছেন অনেক কাল, বাংলাদেশের ইতিহাস অধ্যয়নে তাঁর রয়েছে দীর্ঘ সম্পৃক্ততা। তাঁর প্রণীত আ হিস্টরি অব বাংলাদেশ (২০০৯), প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে আগ্রহীদের কাছে এটা প্রথম-পাঠ হিসেবে সমাদৃত। সচিত্র এই গ্রন্থ সেভাবেই লেখা ও সাজানো, অসংখ্য সাহিত্যিক উদাহরণ ও চিত্রশোভিত। ফান শেন্ডেল পরিচিতিমূলক গ্রন্থই লিখতে চেয়েছিলেন, ইতিহাসের পুনর্বিচার নয়। এমন গ্রন্থেরও বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে।

চন্দ্রশেখর দাশগুপ্তের ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার একেবারে হালের গ্রন্থ, প্রকাশকাল ২০২১। বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে বাইরের জ্ঞানচর্চায় যে পরিবর্তনময়তা, সেটা বোঝা যাবে সিসোন ও রোজের গ্রন্থ শিরোনামের সঙ্গে চন্দ্রশেখরের গ্রন্থনাম তুলনা করলে। সিসোন ও রোজের কাছে বাংলাদেশ ছিল ‘ক্রিয়েশন’, তৈরি করা দেশ এবং সেটা অন্যদের দ্বারা। পক্ষান্তরে চন্দ্রশেখর একে দেখেছেন ‘লিবারেশন’ হিসেবে। সিসোন ও রোজের সামনে আমাদের বোধ করি স্বাদেশিক কণ্ঠ হিসেবে আবদুল লতিফের গান গাইতে হবে, ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারও দানে পাওয়া নয়’। বস্তুত সূচনাকালে বিদেশি কারও কারও মধ্যে এই চেতনা প্রোথিত ছিল, প্রিন্স অব ডেনমার্ককে দূরে রেখে হ্যামলেট রচনা। এদিক দিয়ে ফান শেন্ডেলের গ্রন্থ আমাদের দৃষ্টি কাড়ে সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক উপকরণ ব্যবহারে তাঁর পারঙ্গমতা দ্বারা। তিনি গ্রন্থে সুফিয়া কামালের কবিতা, রাজনীতির পোস্টার, শহীদের সমাধি, সভা-সমাবেশ, জীবনধারার ছবি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছেন।

বাংলাদেশের ইতিহাস নিয়ে বাইরের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা যেকোনো গ্রন্থকে আমরা স্বাগত জানাব। কোনো গ্রন্থই বাইবেল নয়, তবে এসব গ্রন্থ থেকে আমরা পেতে পারি আমাদের উপলব্ধির প্রসার ও নতুন ভাবনায় আলোড়িত হওয়ার অবকাশ, গ্রন্থ-পাঠের সঙ্গে আমরা মিলিয়ে নিতে পারি আমাদের নিজস্ব উপলব্ধি, আমাদের ইতিহাসকে দেখতে পারি বড় পরিসরে। মুক্তিযুদ্ধে নৌ কমান্ডোদের অভিযান আমাদের জন্য বয়ে এনেছিল সাহস, শক্তি ও গৌরব। ক্যাপ্টেন সামন্ত তাঁর বিবরণ দাখিল করেছেন অপারেশন এক্স-এ, আমাদের জন্য যে অভিযান ছিল ‘অপারেশন জ্যাকপট’।

অন্যদিকে গ্যারি বাস দলিলপত্র ঘেঁটে একাত্তরের ৪ নভেম্বর হোয়াইট হাউসে রিচার্ড নিক্সন ও ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকারের যে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন, সেখানে দেখি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নৌ কমান্ডোদের অপারেশনের কথা উল্লেখ করে তিক্ততার সঙ্গে বলেছেন যে বিদ্রোহীরা চট্টগ্রাম বন্দরে সাহায্য-বহনকারী জাহাজে হামলা করেছে। তাঁর মতে এ ধরনের গেরিলা অপারেশন উন্নত মানের প্রশিক্ষণ ও যন্ত্রপাতির সহায়তা ছাড়া সম্পন্ন হতে পারে না। উষ্মার সঙ্গে নিক্সন দোষারোপ করেছিলেন ভারতের ওপর।

তবে ইতিহাস বলে ভিন্ন কথা, নৌ কমান্ডোদের বিভিন্ন স্মৃতিভাষ্যে এবং ইতিহাস-গ্রন্থে বিবরণ রয়েছে মৃত্যুঞ্জয়ী স্কোয়াড কোথা থেকে উঠে এসেছিল, স্বল্পতম সময়ের কঠোর প্রশিক্ষণ নিয়ে লিমপেট মাইন পেটে বেঁধে, খালি গায়ে লুঙ্গি কাছা দিয়ে তাঁরা কীভাবে বিশ্ব-কাঁপানো বিস্ফোরণ ঘটালেন, সেটা বুঝতে পারা সহজ নয়। এই শব্দ হোয়াইট হাউসে ক্ষমতাধর দেশের প্রেসিডেন্টের কানেও পৌঁছেছিল, বিচলিত করেছিল তাঁকে, বুঝে উঠতে পারছিলেন না কীভাবে উন্নত প্রশিক্ষণ ও সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি ছাড়া এমন কাজ সম্ভব হতে পারে!

অসম্ভবকে সম্ভব করেছিল বাংলাদেশ, সেই অর্জনের তাৎপর্য অনুধাবন করতে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় জ্ঞানচর্চার প্রসারতা ও গভীরতা আমাদের কাম্য, প্রত্যাশা দুইয়ের সম্মিলন।

*মফিদুল হক, লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি