বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অনিবার্য

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের সমস্যা ক্রমেই কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর কারণ, বাংলাদেশে সুশাসনের কাঠামো নেই। এ কারণে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি যেকোনো সময়েই হোঁচট খেতে পারে।

সৃজনশীল মানুষ সঠিক নেতৃত্ব পেলে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে বাংলাদেশকে

এ বছরের জানুয়ারি মাসে যখন সারা বিশ্বে কোভিডের সংক্রমণ নিয়ে শোরগোল শুরু হয়, তখন আমি দারিদ্র্যের অর্থনীতি: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নামে একটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি তৈরিতে ব্যস্ত ছিলাম। একুশে বইমেলায় বইটি প্রকাশিত হয়। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে বইটি সম্পর্কে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হলো। সেখানে আমার বক্তব্য ছিল, বাংলাদেশের দারিদ্র্যকে বিদেশিরা ভুল বুঝে অতিরঞ্জিত করেছেন। বাংলাদেশ কখনো ভিক্ষার ঝুড়ি ছিল না। ১৯৭০–এর দশকে দেশের পুনর্গঠন শুরু হয় এবং প্রবৃদ্ধির হার বাড়তে থাকে। ১৯৮০–এর দশকে প্রবৃদ্ধির হার আরও বাড়ে। ১৯৯০–এর দশকে এই প্রবৃদ্ধি বাড়ে উল্লেখযোগ্য হারে। সামরিক শাসনের কবল থেকে মুক্তির পর দেশের প্রবৃদ্ধির হার ত্বরান্বিত হয়।

বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে যে রকম অবমূল্যায়ন করা হয়েছে, দারিদ্র্যের নিরসনকেও তেমনই অতিরঞ্জিত করা হয়েছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, দ্রুত প্রবৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার নাটকীয় হারে কমেছে। তবে তাতে উল্লাসে ভেসে যাওয়ারও কোনো কারণ ঘটেনি।

বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির হিসাব করা হতো জাতীয় দারিদ্র্যরেখার ভিত্তিতে। এই হিসাবে দারিদ্র্য থেকে মুক্তির জন্য বড় ধরনের মাথাপিছু আয়ের প্রয়োজন ছিল না। জাতীয় দারিদ্র্যরেখার ভিত্তিতে দারিদ্র্য নিরসনের যে সাফল্য, সেটা বাস্তব, কিন্তু সম্পূর্ণ নয়। এখানে চারটি বিষয় সম্পর্কে আমাদের সজাগ থাকা দরকার। প্রথমত, দারিদ্র্যের সংজ্ঞা নির্ভর করে একটি দেশের অর্থনৈতিক শ্রেণির ওপর। দেশগুলোর মোটামুটি চার ধরনের অর্থনৈতিক শ্রেণি আছে—স্বল্প আয়ের দেশ, নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ, মধ্যম আয়ের দেশ ও উচ্চ আয়ের দেশ। ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংক হিসাব করে দেখেছে, স্বল্প আয়ের দেশে দারিদ্র্যরেখার ঊর্ধ্বে থাকার জন্য দৈনিক আয় ১ দশমিক ৯ পিপিপি ডলার (ক্রয়সক্ষমতার সমতাভিত্তিক), নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে ৩ দশমিক ২ পিপিপি ডলার, মধ্যম আয়ের দেশে ৫ দশমিক ৫ পিপিপি ডলার এবং উচ্চ আয়ের দেশে ২১ দশমিক ৭ পিপিপি ডলার হতে হবে। বাংলাদেশ এখন নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের দারিদ্র্যরেখা এখন ১ দশমিক ৯ পিপিপি ডলার নয়, ৩ দশমিক ২ পিপিপি ডলারে উন্নীত হয়েছে। আমরা আশা করছি, আগামী দুই দশকে বাংলাদেশ পর্যায়ক্রমে মধ্যম আয়ের দেশ ও উচ্চ আয়ের দেশে উঠে যাবে। মধ্যম আয়ের দেশে উঠতে হলে দৈনিক আয় হতে হবে ৫ দশমিক ২ পিপিপি ডলার এবং উচ্চ আয়ের দেশ হতে হলে ২১ দশমিক ৭ পিপিপি। এ হিসাব ২০১১ সালের। ২০১৯ সালে এই হিসাব আরও ওপরে উঠে যাবে। আমাদের দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নতি করতে হলে দারিদ্র্যরেখার ওপরে উঠে যাওয়ার জন্য আগামী দুই দশকে অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে দারিদ্র্য নিরসন করা সম্ভব হবে কি না, তা ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে একটি ধারণা সৃষ্টি করা হয়েছে যে দেশ থেকে এক-দুই দশকের মধ্যে দারিদ্র্য সম্পূর্ণভাবে দূর হয়ে যাবে। এই ধারণা কিন্তু ভুল। পৃথিবীর কোনো উন্নত দেশেই দারিদ্র্য পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে গরিব মানুষ ছিল জনসংখ্যার সাড়ে ১৪ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে গরিব ছিল প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষ, আর ইউরোপীয় ইউনিয়নে ছিল ২৫ শতাংশ।

আকবর আলি খান

অর্থনীতিবিদদের দারিদ্র্যের সংজ্ঞার বাইরে আরও একটি সংজ্ঞা আছে। সেটি হলো দেশের কত শতাংশ মানুষ নিজেদের গরিব বলে মনে করেন। ২০০৯ সালে অর্থনীতিবিদ এস আর ওসমানীর নেতৃত্বে একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৩২ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ নিজেদের গরিব বলে মনে করেন। সংখ্যাটি বাংলাদেশের দারিদ্র্য হারের অনেক বেশি।

বাংলাদেশের দারিদ্র্য নিরসনের ভিত্তি সুদৃঢ় নয়। ভিত্তিটি ভঙ্গুর। বাংলাদেশে যারা দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়েছে, তারা অনুকূল অর্থনৈতিক পরিবেশে কোনোরকমে দারিদ্র্যরেখা অতিক্রম করে। অনুকূল পরিবেশ পরিবর্তিত হলে বিপুল জনসংখ্যা দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে।

আমরা আশা করছি, আগামী দুই দশকে বাংলাদেশ পর্যায়ক্রমে মধ্যম আয়ের দেশ ও উচ্চ আয়ের দেশে উঠে যাবে। মধ্যম আয়ের দেশে উঠতে হলে দৈনিক আয় হতে হবে ৫ দশমিক ২ পিপিপি ডলার এবং উচ্চ আয়ের দেশ হতে হলে ২১ দশমিক ৭ পিপিপি।

কোভিড–১৯ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যে ভঙ্গুরতা সৃষ্টি করেছে। শুধু গণস্বাস্থ্যে নয়, সারা বাংলাদেশে বৃহত্তর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই। কর্মসংস্থান কমেছে, বেকারত্ব বেড়েছে, অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ধ্বংস হয়ে গেছে। প্রশ্ন হলো, কোভিডের প্রকোপ কমে এলে এই ক্ষয়ক্ষতি কি আপনা–আপনিই উধাও হয়ে যাবে? বাংলাদেশের আশাবাদী অর্থনীতিবিদেরা দাবি করছেন, কোভিড চলে গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। আবার দ্রুত প্রবৃদ্ধি শুরু হবে। দারিদ্র্য নিরসনের যে পথে আমরা ছিলাম, সে পথে এগিয়ে যেতে থাকব। এ ধরনের প্রবৃদ্ধিকে তাঁরা ইংরেজি ‘ভি’ অক্ষরের মতো প্রবৃদ্ধি বলে থাকেন। ভি অক্ষরে রেখাটি নিচের দিকে নেমে আসে। সর্বনিম্ন বিন্দুতে নেমে এসে আবার খাড়া রেখা ঊর্ধ্বগতিতে ওপরে উঠে যায়।

শুধু বাংলাদেশ সরকার নয়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে আশাবাদী। আইএমএফের প্রক্ষেপণ অনুসারে, আগের বছরের তুলনায় এবার প্রবৃদ্ধি কমবে। তবে ভারতের চেয়ে প্রবৃদ্ধি বেশি হবে। ভারতের চেয়ে প্রবৃদ্ধি বেশি হওয়া সুসংবাদ, কিন্তু যথেষ্ট নয়। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ও তাঁর সহকর্মী জঁ দ্রেজ আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন, কোভিড–পূর্ব ভারতের দ্রুত প্রবৃদ্ধির ‘আনসারটেন গ্লোরি’ বা ‘অনিশ্চিত মহিমা’ দিয়ে কোভিডের ধ্বংসলীলা পেছনে ফেলা সম্ভব না–ও হতে পারে। কাজেই প্রশ্ন ওঠে, কোভিড–পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানও কি সহজ হবে, নাকি নতুন বাধা অতিক্রম করতে হবে?

আমার ধারণা, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের সমস্যা ক্রমেই কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর কারণ, বাংলাদেশে সুশাসনের কাঠামো নেই। এ কারণে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি যেকোনো সময়েই হোঁচট খেতে পারে। সুশাসনের কাঠামো গড়ে তোলার জন্য প্রথমে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রয়োজন রয়েছে। এখানে এ প্রশ্ন উঠতে পারে, অব্যাহত প্রবৃদ্ধির জন্য কি গণতন্ত্র আবশ্যিক? পৃথিবীর অনেক স্বৈরতান্ত্রিক দেশেও তো দীর্ঘদিন ধরে প্রবৃদ্ধি চলছে। প্রকৃতপক্ষে দুই কারণে গণতন্ত্রের প্রয়োজন। প্রথমত, ইতিহাস শিক্ষা দেয়, কোনো রাষ্ট্রেই একটি বংশ বা একটি দল চিরদিন ক্ষমতায় থাকতে পারে না। ক্ষমতার পরিবর্তন তখনই শান্তিপূর্ণভাবে ঘটবে, যখন দেশে গণতান্ত্রিক উপাদানগুলো উপস্থিত থাকবে। দ্বিতীয়ত, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গরিবদের খুশি না রাখলে নির্বাচনে ভোট পাওয়া যায় না। কাজেই রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হলেই দ্রুত দারিদ্র্য নিরসন হবে।

সুশাসনের জন্য আইনের শাসন অপরিহার্য। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও পুলিশের কার্যক্ষমতা। দীর্ঘদিন ধরে বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, ফৌজদারি মামলার নিম্নস্তরের বিচারকেরা নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্বাধীন থাকায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে। সম্প্রতি বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন করা হয়েছে। এটি সুশাসনের সমর্থকদের জন্য অভিনন্দনযোগ্য পদক্ষেপ। কিন্তু এর সুফল জনগণের কাছে পৌঁছায়নি। হাইকোর্টে শ খানেক মহামান্য বিচারক নিয়োগ করা হয়েছে। বিচার বিভাগের জন্য বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। নিম্নস্তরের ফৌজদারি মামলা পরিচালনার জন্য সাড়ে ৭০০ নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। (ঠিক সাড়ে ৭০০ না হলেও কমপক্ষে ৫০০ সাবেক ম্যাজিস্ট্রেটের এখন আর কাজ নেই। সরকারকে এর দায় বহন করতে হচ্ছে)।

এরপরও পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না কেন? এর একটি সহজ ব্যাখ্যা হতে পারে, বিচারকদের কাজের সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। সত্যিই কি সব মহামান্য বিচারক দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করছেন, না মামলা জমাচ্ছেন? সিদ্ধান্ত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কি তাঁরা রায় লিখছেন, নাকি অবসর গ্রহণের দেড়-দুই বছর পর লিখছেন? যদি জাতীয় সংসদে প্রতিবছর বিচার বিভাগের মূল্যায়নসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন পেশ করা হয়। সেই প্রতিবেদনের ওপর গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ ও জাতীয় সংসদে আলোচনা হয়, তাহলে পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে।

পুলিশ বিভাগের বিপুল সম্প্রসারণ হয়েছে, কিন্তু কাজের মান বাড়েনি। মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। হাইকোর্ট অভিযোগ করছে, মানবাধিকার কমিশনের কোনো কোনো কর্মকর্তা নিজেরাই মানবাধিকার লঙ্ঘনে মদদ দিচ্ছেন। তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এর প্রভাব সামান্য। পুলিশের দায়িত্ব হলো যারা খুন, রাহাজানি, ধর্ষণ ইত্যাদি মারাত্মক অপরাধ করে, তাদের ধরে বিচার করার ব্যবস্থা করা। পুলিশ এ কাজ করবে তো কী, বাংলাদেশের সংবিধানে প্রদত্ত নাগরিকদের এফআইআর (প্রথম তথ্য প্রতিবেদন) ও জিডি এন্ট্রির (সাধারণ নিবন্ধনে অন্তর্ভুক্তি) অধিকার এখনো অনেক ক্ষেত্রেই নিয়ে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ পুলিশের কাছে নালিশ করতে চাইলে পুলিশ সব ক্ষেত্রে নালিশ গ্রহণ করে না। পুলিশ যেসব নালিশ গ্রহণ করে, সেসব ক্ষেত্রে যাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া যায়, তাদের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। যাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়, সেসব আসামির বড়জোর ৫ শতাংশ সাজা পায়। বাকি ৯৫ শতাংশ ছাড়া পেয়ে যায়। যে দেশে মারাত্মক অপরাধ করে ৯৫ শতাংশের সাজা না পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, সে দেশ অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য দেশে সুশাসনের প্রয়োজন। মানবসম্পদ উন্নয়নের অর্থ হলো দেশে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার উন্নয়ন নিশ্চিত করা। স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ১ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থ সরকার বরাদ্দ করে থাকে। এ বরাদ্দ অপ্রতুল। এই বরাদ্দ অবিলম্বে কমপক্ষে দ্বিগুণ করা জরুরি। স্বাস্থ্য খাতে সরকারের প্রশাসন এত দুর্বল যে বর্তমানের বরাদ্দ খরচ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিপুল অর্থের অপচয় হচ্ছে। কোভিড–১৯ সংক্রমণের পর সাধারণ মানুষের জন্য সরকারি হাসপাতালে সরকার থেকে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত ৯ মাসে অর্থ বরাদ্দে কী কী কেলেঙ্কারি হয়েছে, প্রতিদিন তা খবরের পাতায় দেখতে পাচ্ছি।

বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে সুশাসনের ব্যর্থতা পর্বতপ্রমাণ। শিক্ষা খাতে সরকার উল্লেখযোগ্য হারে বরাদ্দ বাড়িয়েছে। শিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। শিক্ষকদের বেতন বেড়েছে। অথচ ছাত্রদের সঙ্গে শিক্ষকদের দেখা হচ্ছে না। অনেক শিক্ষক ক্লাস নেন না। যাঁরা ক্লাস নেন, তাঁরা ক্লাসে পড়ান না। পৃথিবীর কোনো দেশে বাংলাদেশের মতো প্রাইভেট টিউশন এত কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। শিক্ষা খাতের বরাদ্দ বাড়ার পর কি শিক্ষায় এ অধঃপতন অনিবার্য ছিল? ঔপনিবেশিক শাসন আমলে বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন কম ছিল। কিন্তু ছাত্রদের তাঁরা যে নিষ্ঠায় গড়ে তুলেছেন, আজকের দিনে তা অচিন্তনীয়।

একটি উদাহরণ দিই। ১৯৪০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের কৃতী ছাত্র (বিএ অনার্স ও এমএ—উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থানের অধিকারী) অশোক মিত্র। তিনি আইসিএসের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নেন। আইসিএসে তিন ধরনের ইতিহাসের জ্ঞান পরীক্ষা করা হতো। ১. আধুনিক ইংল্যান্ডের ইতিহাস, ২. আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস, ৩. ভারতের মধ্য ও আধুনিক যুগের ইতিহাস। অশোক মিত্র পরীক্ষার জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন, বুঝতে পারছিলেন না। পরিচিত ব্যক্তিদের পরামর্শ চাইলে তাঁরা প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ সুশোভন সরকারের সঙ্গে দেখা করার পরামর্শ দিলেন। তিনি সুশোভন সরকারের কাছে গিয়ে সাহায্য চাইলেন। সুশোভন সরকার বললেন, সাহায্য করতে পারবেন কি না, সে জন্য এক সপ্তাহ সময় লাগবে। এক সপ্তাহ পর গেলে সুশোভন সরকার বলেন, তিনি ইতিহাস পড়াতে পারবেন। এক সপ্তাহ কেন লাগল, জানতে চাইলে সুশোভন সরকার বললেন, এসব বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ের বই ছিল না। নিজের অর্থে তিনি কিছু প্রয়োজনীয় বই কিনেছেন এবং পাঠ করেছেন। সুশোভন সরকার সপ্তাহে তিন দিন এক ঘণ্টা করে আস্তে আস্তে বক্তৃতা দিতেন। অশোক মিত্র তাঁর কথাগুলো টুকে নিতেন। পুরো পাঠ্যক্রম শেষ করতে ৯ মাস সময় নিলেন।

এই প্রাইভেট টিউশনের ফল হলো আইসিএস পরীক্ষায় ৬টি পেপারে গড়ে ৭২ শতাংশ নম্বর পেয়ে ভারতে আইসিএস পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন অশোক মিত্র। এতে অশোক মিত্রের দুই ধরনের লাভ হলো। প্রথমত, প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজি পড়ে তাঁর ইংরেজি ভাষাজ্ঞান পরিপূর্ণতা লাভ করেনি। সুশোভন সরকারের বক্তব্য শুনে তিনি ইংরেজি লিখতে শেখেন। দ্বিতীয়ত, আইসিএসে যোগ দেওয়ার আগে তাঁর বন্ধুরা অশোক মিত্রের পয়সায় কলকাতার একটি বড় হোটেলে খাওয়ার দাবি করেন। অশোক মিত্র তখন বেকার। আইসিএস পরীক্ষায় অংশ নেওয়া এক প্রার্থী অশোক মিত্রের বক্তৃতার খাতাটি ৮০ টাকায় কিনে নেন। এই ৮০ টাকায় বিলেত যাওয়ার ব্যয় মেটান তিনি। এই ছিল বাংলাদেশের প্রাইভেট টিউশনের নমুনা। আজ সেই অবস্থা থেকে আমরা কোথায় পৌঁছেছি, সেটা ভাবলেও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়।

নিঃসন্দেহে আমাদের সমস্যা অনেক ব্যাপক ও তীব্র। প্রশ্ন জাগতে পারে, এ সমস্যার সমাধান আমরা কীভাবে করব? আমার মনে হয়, এ নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। একবার যদি সুশাসনের পথে আমাদের যাত্রা শুরু হয়, তাহলে আমরা আবার অতি দ্রুত অভীষ্ট লক্ষ্যে ফিরে যেতে পারব। বাংলাদেশের ইতিহাস আমাদের আশাবাদী হতে শিখিয়েছে। পাকিস্তানের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ–উত্তর বাংলাদেশে অনেক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও গরিব কৃষকেরা ধানের ফলন প্রায় চার গুণ বাড়িয়েছেন। বাংলাদেশের শিক্ষাবঞ্চিত নারীরা পোশাকশিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে বাংলাদেশকে পৃথিবীর একটি বড় পোশাক রপ্তানিকারক দেশে পরিণত করেছেন। বাংলাদেশের অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত শ্রমিকেরা বিদেশে গিয়ে কঠোর পরিশ্রম করে বৈদেশিক মুদ্রার অভাব ঘুচিয়েছেন এবং দেশে পরিবার-পরিজনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করেছেন। অষ্টম শতকে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পাল সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করা হয়। বাংলাদেশের মানুষ সব সময় তাদের ন্যায্য অধিকার রক্ষায় যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত ছিল এবং আছে। এ ধরনের সৃজনশীল মানুষ সঠিক নেতৃত্ব পেলে অদূর ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে নিশ্চিত এগিয়ে যাবে।


আকবর আলি খান সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা