মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার চা-বাগানঘেরা এলাকা বরমচাল। এখানকার রেলস্টেশনের পাশেই বাড়ি জাহাঙ্গীর উদ্দিনের। গতকাল সোমবার ভোররাত পৌনে চারটার দিকে জাহাঙ্গীরকে দেখা গেল হাঁটুসমান পানিতে টর্চলাইটের আলো ফেলে খোঁজাখুঁজি করতে। কী খুঁজছেন—জানতে চাইতেই বললেন, ‘আহত মানুষ’।
চা-বাগান থেকে নেমে আসা বড়ছড়া খালের ওপর ছোট রেলসেতুটি ভেঙে গত রোববার রাতে উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনের একটি বগি পানিতে পড়ে যায়। রাতভরই এখানে হতাহত মানুষের খোঁজে পানিতে খোঁজাখুঁজি চালিয়েছেন স্থানীয় লোকজন। অন্য রকম এক মানবতায় রাত পেরিয়ে ভোর আসে বরমচালে। দিনের আলোয় দূরদূরান্তের লোকও ছুটে আসেন। রেললাইন উপুড় হয়ে, উল্টে-পাল্টে থাকা বগিগুলো দেখে তাঁরাও আর্তনাদ করে ওঠেন।
ট্রেনের যাত্রীরা বলছেন, দুর্ঘটনার পরপরই গ্রামবাসী এসে উদ্ধারকাজ শুরু করেন। আধা ঘণ্টা থেকে ৪০ মিনিট পর আসে ফায়ার সার্ভিসসহ অন্য বাহিনীগুলো। শুধু হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধারই নয়, তাঁদের হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া, ট্রেনযাত্রীদের রাতে আশ্রয় দেওয়া এবং অতিথির মতো রাতে ও সকালের খাবারও খাইয়েছেন স্থানীয় লোকজন।
ভোররাত চারটার দিকে দুর্ঘটনাস্থলে পাওয়া গেলে কুলাউড়ার ভাটেরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামকে। বরমচাল স্টেশন থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরের ভাটেরা গ্রাম থেকে উদ্ধারে অংশ নিতে এসেছেন শ-খানেক লোক। ইউপি চেয়ারম্যান তাঁদের নেতৃত্বে। দুর্ঘটনাস্থলে চিৎকার করতে করতে গলা ভেঙে গেছে নজরুল ইসলামের। জানালেন, দুর্ঘটনার খবর শুনেই তিনি পুরো এলাকার মসজিদে মাইকিং করার ব্যবস্থা করেন। ঘুমাতে যাওয়ার সময় মাইকিং শুনে ঘর থেকে বের হয়ে ঘটনাস্থলে আসেন গ্রামবাসী। চলে হাতে হাতে উদ্ধার তৎপরতা।
একটি বগি থেকে নিহত একজন ও চারজন নারী যাত্রীকে উদ্ধার করেছেন বলে জানালেন কুলাউড়া স্টেশনের রিকশাচালক মোহাম্মদ ফারুক ও কৃষক হিরা মিয়া। দুজনই জানালেন, ট্রেনটি দুর্ঘটনায় পড়ার পর একনাগাড়ে ট্রেনের বগিগুলো থেকে যাত্রীদের বের করার কাজ করেন। এরপর পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসসহ প্রশাসনের লোকজন আসেন। তারপর উদ্ধার হওয়া যাত্রীদের মধ্য থেকে জখমপ্রাপ্তদের হাসপাতালে নেওয়ার কাজ শুরু হয়। কৃষক হিরা মিয়া বলেন, ‘সারা দিন খেতে আছলাম। বাড়িত গিয়া চোখটা লাগা মাত্র মাইকে ঘটনা জানি। উদলা (খালি গায়ে) শরীরে বাইর অইয়া উদ্ধারে লাগছি।’
>শুধু হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধারই নয়, তাঁদের হাসপাতালে নেওয়া, যাত্রীদের রাতের আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থা করেছেন স্থানীয়রা।
এই দুজনের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন মসজিদে ফজরের আজান শোনা যাচ্ছিল। আঁধার কাটার সঙ্গে সঙ্গে সিলেট ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে ট্রেনের বগিগুলোতে তল্লাশি শুরু হয়। ১১টি দলে ভাগ হয়ে তল্লাশির পর ট্রেনে আর কোনো মানুষ নেই বলে তাঁরা জানালে হাঁপ ছাড়েন উদ্বিগ্ন স্থানীয় লোকজন।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমরা যখন ঘটনাস্থলে আসি, তখন স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতা কেমন হবে, এ নিয়ে সংশয়ে ছিল। রেললাইনের পাশের কিছু মানুষ তো চলন্ত ট্রেনে পাথর ছুড়ে বলেও শোনা যায়। সে কারণে দলের সব সদস্যের মাথায় হেলমেট ছিল। কিন্তু ঘটনাস্থলে এসে দেখা গেল ফায়ারের সদস্যদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছেন স্থানীয় লোকজন।’
আর বরমচাল রেলস্টেশন লাগোয়া কালা মিয়া বাজারের সব ব্যবসায়ীই এসে দাঁড়িয়েছিলেন বিপদে পড়া যাত্রীদের পাশে। বাজারের পানের দোকানদার লিলু মিয়ার বাড়ি রেললাইনের পশ্চিমে ইসলামপুর গ্রামে। রাতে বাড়ি ফিরে যখন খেতে বসেছিলেন, তখনই দুর্ঘটনা। সেই অবস্থাতেই ছুটে আসেন তিনি। যাঁরা আহত, তাঁদের হাসপাতালে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করার পাশাপাশি যাঁরা অক্ষত ছিলেন, রাতে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন বাজারের ব্যবসায়ীরা।
বাজারের মুদি ব্যবসায়ী জুনাব আলীর বাড়িসহ আশপাশের ছয়টি বাড়িতে ২১ জন নারী ও শিশু ট্রেনযাত্রী আশ্রয় নিয়েছিলেন। সকালে মোট ৪০ জনের নাশতার জন্য বাজার করতে হয়েছে জুনাব আলীকে। তিনি বলেন, ‘রাতে মনে অইছিল আমরা বুঝি দিনে শুধু লাশ আর লাশ বহন করব। শুকরিয়া, সকালবেলা তেমনটা আর দেখি নাই।’
চায়ের ফ্লাস্ক হাতে সকাল আটটার দিকে কালা মিয়া বাজারের পাশে একজন গৃহিণীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। জানালেন, উদ্ধারকারীদের চা-পান করাতে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন।
রাত থেকেই মানুষের সঙ্গে ঘটনাস্থলে ছিলেন কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ আবুল লাইছ। আশপাশের মানুষের মানবিকতায় মুগ্ধ এই কর্মকর্তা দুপুরে ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘কত আশঙ্কাই না ছিল। কিন্তু সবাই মানবিক থাকায় এখন সবকিছুই কেমন জানি অলৌকিক মনে হচ্ছে।’