মন্ত্রী দুর্গত এলাকা পরিদর্শন করেন ত্রাণের টাকায়

টিআইবি
টিআইবি

এ বছরের বন্যায় দেশের উত্তরাঞ্চল ও সিলেট অঞ্চলের ২৮ উপজেলার মানুষের ক্ষয়ক্ষতি ১৯৮৮ সালের ক্ষয়ক্ষতিকেও ছাড়িয়ে গেছে। এর বিপরীতে সরকারি সহায়তা ছিল নগণ্য। ত্রাণ বিতরণে ছিল বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম।

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তালিকা করা হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনা ও স্বজনপ্রীতি করে। অভিযোগ আছে, মন্ত্রীর দুর্গত এলাকা পরিদর্শনের ব্যয় মেটানো হয়েছে ত্রাণের টাকা থেকে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বন্যা-পরবর্তী এক গবেষণা চালিয়ে আজ রোববার এ তথ্য জানিয়েছে। রাজধানীর মাইডাস সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে গবেষণাপত্রটি উপস্থাপন করা হয়।

গবেষণায় বলা হয়েছে, বন্যার সময় ও পরে ত্রাণ বিতরণের জন্য রাজনৈতিক বিবেচনা এবং স্বজনপ্রীতি করে তালিকা করা হয়েছে। কেউ প্রতিবাদ করলে তাঁকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। জনপ্রতিনিধিদের প্রত্যাশিত ভূমিকা ছিল না। কোনো এলাকায় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা অধিকতর ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে আত্মীয়স্বজনের তালিকা প্রণয়ন করেছেন। দুর্গত মানুষের মধ্যে মাথাপিছু বরাদ্দের চেয়ে কম ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। জিআর চাল ১০ কেজির বদলে ৩ থেকে ৮ কেজি করে দেওয়া হয়েছে। আবার কাউকে কাউকে দুবারও দেওয়া হয়েছে।

গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, বন্যা চলাকালে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারপ্রতি ত্রাণ বরাদ্দ ছিল ৪ থেকে ৭৬ টাকা পর্যন্ত। বন্যার পর সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ঘরপ্রতি গড়ে ২০ থেকে ৭৭২ টাকা পর্যন্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা ছিল প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য।

ত্রাণ পরিবহনে বরাদ্দ না থাকায় অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে তা মেটানো হয়েছে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে। উপজেলা পর্যায়ে চালের বস্তা পরিবহনে সরকারি বরাদ্দ না থাকার অজুহাতে চেয়ারম্যানরা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের নির্ধারিত বরাদ্দের চেয়ে কম চাল দিয়েছেন।

এ বছরের বন্যায় ২৮টি উপজেলায় স্থানভেদে ৪০ লাখ মানুষ ১০ থেকে ১৫ দিন পানিবন্দী ছিল। সরকারি হিসাবে ১০৮ জনের প্রাণহানি ঘটেছে, বেসরকারি হিসাবে যা ছিল ১১৯। বন্যায় কিছু উপজেলার ৮০ শতাংশ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যায়। যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ১৬৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, যা ১৯৮৮ সালের বন্যার চেয়ে বেশি ছিল। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ছিল ৯৮ হাজার ৬৮৮টি, আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ১৩ লাখ ৬০ হাজার ১২০টি। মোট ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি ছিল ৩৪ হাজার ৯৯৯টি এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ছিল ৫ লাখ ৪৭ হাজার ৯৬৭টি। মোট ক্ষতিগ্রস্ত জমি ছিল ৪৫ হাজার ৯৬৬ হেক্টর এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ৯৪ হাজার ১৮৩ হেক্টর। ক্ষতিগ্রস্ত ৩১ শতাংশ খানার ফসলি জমি বালু পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব জমিতে আগামী দুই থেকে তিন বছর ভালো ফসল না হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।

গবেষণায় বলা হয়েছে, আশ্রয়কেন্দ্রে বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য উপযোগী ব্যবস্থা ছিল না। কোনো কোনো আশ্রয়কেন্দ্র তালাবদ্ধ থাকায় বন্যায় আক্রান্ত মানুষ সময়মতো আশ্রয় নিতে পারেনি। বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশনের ঘাটতি ছিল। আক্রান্ত ব্যক্তিদের নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়ার প্রচারণায় স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের ঘাটতি ছিল।

গবেষণায় বন্যা মোকাবিলা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সরকারের গৃহীত কিছু পদক্ষেপের প্রশংসাও করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বন্যার আগে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর থেকে নদীর পানি বৃদ্ধি ও বন্যার পূর্বাভাসসংক্রান্ত তথ্য নিয়মিত প্রকাশ করা হয়েছে। বন্যা সম্পর্কে সতর্কবার্তা পাঠানোর জন্য জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বন্যা চলার সময়ে সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোতে সীমিত পরিসরে ত্রাণ বরাদ্দ করা হয়। জরুরি ভিত্তিতে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের তহবিল ব্যবহার করে শুকনা খাবার, স্যালাইন ইত্যাদি বিতরণ। বন্যার পর সীমিত পরিসরে চিকিৎসাসেবা, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তালিকা সংগ্রহের চেষ্টা, সীমিত পরিসরে গৃহনির্মাণসামগ্রী বিতরণ এবং কৃষকদের জন্য বীজ, সার বরাদ্দসহ অন্যান্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বেড়েছে। তা সত্ত্বেও আরও অনেক কিছুই করার আছে। যেমন গৃহীত ব্যবস্থায় অনেক ঘাটতি ছিল। যথাসময়ে ব্যবস্থা নিলে ক্ষতির পরিমাণ অনেক কমিয়ে আনা যেত। ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। এনজিওগুলো তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেনি। ক্ষেত্রবিশেষ তারা নিজেদের উপকারভোগীদের বেশি সহযোগিতা করেছে। মন্ত্রী বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন করবেন তাঁর কাজের অংশ হিসেবে। তবে কোথাও কোথাও মন্ত্রীর পরিদর্শন ব্যয় মেটানো হয়েছে ত্রাণের বরাদ্দ থেকে।’