বন্যায় আরও বিপাকে তাঁরা

কুড়িগ্রামের এ উপজেলার ৬ হাজার ৪০০ পরিবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত। গতকাল পর্যন্ত ত্রাণ পেয়েছে মাত্র ৫৩০টি পরিবার।

নূর জামাল ও ফাতেমা দম্পতির ঘর ছিল কুড়িগ্রামের চর রাজীবপুরের শংকর মাধবপুরে। নদীভাঙনের মুখে সেই ঘর ভেঙে নিয়ে এসেছেন ভেলামারী চরে। বন্যার কারণে ঘর তোলার কাজ থেমে ছিল। পানি কমায় আবার শুরু করেছেন ঘরের কাজ। গত শনিবার বিকেলে

কুড়িগ্রামের চর রাজীবপুর উপজেলায় বন্যার পানি এসেছে দুই সপ্তাহ হতে চলল। তবে অবস্থা খারাপ হয় সপ্তাহখানেক আগে। ঘরে কোমরসমান পানি ওঠায় বাড়ি ছাড়তে হয় মনোয়ারা বেগমকে। আশ্রয় নেন এক প্রতিবেশীর উঁচু বাড়িতে। মনোয়ারা বললেন, ‘যহন দার (তীব্র স্রোত) ছুইটা আহে, তহন পাশে অন্য মাইনষের বাইত্তে (বাড়িতে) চইলা যাই। হেয়ানেই থাহি।’

মনোয়ারার বাড়ি কোদালকাটি ইউনিয়নের শংকর মাধবপুরে। গ্রামটি ব্রহ্মপুত্র নদের চরে। গত শনিবার বিকেলে বাড়িতে ফেরেন মনোয়ারা। তখন বাড়ি থেকে পানি নেমে গেছে ঠিকই, তবে ঘর-উঠানে থকথকে কাদা।

২০ বছর আগে স্বামী কাজের সন্ধানে গিয়ে আর ফেরেননি। মেয়ে আমিনা, পঙ্গু মেয়েজামাই আলাউদ্দিন ও নাতি আতিককে নিয়ে মনোয়ারার সংসার। এর-ওর বাড়িতে কাজ করেন। মাটি কাটার কাজও করেন। তবে বন্যার কারণে কোনো কাজ নেই। মনোয়ারা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘কাজকাম নাই। ক্যামনে দিন যাব?’

যেখানকার প্রায় সব মানুষ গরিব, সেখানে ত্রাণ নিয়ে বৈষম্য কেন?
আমিনুর রহমান, সহকারী শিক্ষক, সাজাই দাখিল মাদ্রাসা, চর রাজীবপুর, কুড়িগ্রাম

এ পর্যন্ত সরকারি কোনো ত্রাণ পাননি অভিযোগ করে মনোয়ারা জানান, শুক্রবার একটি এনজিও থেকে ২ কেজি চিড়া, ১ কেজি মুড়ি ও ৫০০ গ্রাম চিনি দিয়েছে। প্রতিবেশীর কাছ থেকে ৫ কেজি চাল ধার নিয়েছেন।

মনোয়ারার মতো চর রাজীবপুরের সদর, কোদালকাটি ও মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের অন্তত ৩২ হাজার বাসিন্দা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারও ঘর ভেঙে গেছে, কারও ফসল নষ্ট হয়েছে। কাজ বন্ধ থাকায় হাতে টাকা নেই।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, চর রাজীবপুরে দেশের সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষের বাস। দারিদ্র্যের হার ৭৯ দশমিক ৮। উপজেলাটির জনসংখ্যা প্রায় ৮৫ হাজার। অন্তত ৩০টি চর আছে এ উপজেলায়। এসব চরের বাসিন্দাদের বেশির ভাগ হতদরিদ্র।

শংকর মাধবপুরের বিলপাড়া চরে শনিবার বিকেলে গিয়ে দেখা গেল, বাড়িঘর থেকে বন্যার পানি নেমেছে। তবে বেশির ভাগ পরিবার বাড়িঘরে ফেরেনি।

খলিল-আমেলা দম্পতির থাকার জন্য একটি খড়ের ঘর আর ছাগল রাখার আরেকটি ছোট ঘর। বন্যায় ছাগল রাখার ঘরটি ভেঙে পড়েছে। বাড়িতে পানি ওঠায় তাঁরা আশ্রয় নিয়েছেন এক আত্মীয়ের বাড়িতে। প্রতিবেশী নুরুল আমিন বললেন, পরিবারটি হতদরিদ্র। কয়েকটি ছাগল পালন করে কোনোমতে বেঁচে আছে।

রাজীবপুর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, রাজীবপুরে প্রতিবছর বন্যার সময় কয়েক হাজার পরিবার নদীভাঙনের শিকার হয়ে উদ্বাস্তু হয়। এমনও দেখা যায়, কারও ২০০-৩০০ বিঘা জমি ছিল, এখন বসবাসের জায়গাটুকুও নেই।

উপজেলার ৩২ হাজার মানুষ বন্যাকবলিত হয়েছে উল্লেখ করে চর রাজীবপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্বে) আজিজুর রহমান বলেন, গতকাল পর্যন্ত ত্রাণসামগ্রী পেয়েছে ৫৩০টি পরিবার।

একটি পরিবারের সদস্যসংখ্যা ৫ জন করে ধরলে বন্যাকবলিত পরিবারের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬ হাজার ৪০০। এ হিসাবে ৮ শতাংশ পরিবার ত্রাণ পেয়েছে। ত্রাণ অপ্রতুল থাকার কথা স্বীকার করেন ইউএনও অমিত চক্রবর্তীও। তিনি বলেন, বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য জেলা প্রশাসককে চাহিদাপত্র দিয়েছেন।

বিভিন্ন চর ঘুরে অপর্যাপ্ত ত্রাণ নিয়ে বানভাসি মানুষের মধ্যে ক্ষোভ দেখা গেল। দুর্নীতির অভিযোগও করেন কেউ কেউ। স্থানীয় একটি মাদ্রাসার শিক্ষক আমিনুর রহমান বলেন, যেখানকার প্রায় সব মানুষ গরিব, সেখানে ত্রাণ নিয়ে বৈষম্য কেন?