রাজধানীর পলাশী মোড় সরগরম থাকত রাতভর। এখন রাত বাড়লেই জায়গাটা খাঁ খাঁ। প্রায় এক মাস ধরে সেখানে চায়ের আড্ডা জমে না। ঘুমহীন রাত কাটাতে গিয়ে ফেরত আসতে হয় শিক্ষার্থীদের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মাঝামাঝি পলাশী মোড়ের অবস্থান। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের বাইরেও ঢাকা কলেজ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের গভীর রাতে আড্ডাস্থল এই পলাশী। রাতে কাজ করতে হয় এমন পেশার মানুষজনও এখানে রাতের নাশতা ও চা খেতে আসেন। কিন্তু ৬ জানুয়ারি থেকে এখানকার সব দোকান বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ।
একাধিক ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেন, ৬ জানুয়ারি সন্ধ্যার দিকে পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে এক শিক্ষার্থীর কথা-কাটাকাটি হয়। এরপর রাতেই পুলিশ এসে সব দোকান তুলে দেয়। কয়েকজনকে ধরে নিয়ে যায়। তবে কোন কর্মকর্তার সঙ্গে এই বিরোধ, সেটা কেউ স্পষ্ট করে বলতে পারেননি।
তবে অভিযোগটি সত্য নয় বলে দাবি করেছেন লালবাগ জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মো. নাজির আহমেদ খান। তিনি বলেন, পলাশী চারটি রাস্তার গুরুত্বপূর্ণ মোড়। এখানে ফুটপাতে দোকান করা ঝুঁকিপূর্ণ। শিক্ষার্থী ও বহিরাগতদের উপস্থিতি এখানে যানবাহন ও লোকজনের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে।
পলাশীর মোড়ে একটি পরোটার দোকান, সাত-আটটি চায়ের দোকান, দুটি জুস কর্নার, একটি ফাস্ট ফুডের দোকান রয়েছে। এ ছাড়া ভাসমান কিছু দোকানে চা-সিগারেট, ফুচকা, হালিম, ফলমূল বিক্রি হয়। রাত ১২টার পর থেকে পরোটার দোকানসহ বেশ কিছু দোকান খোলা থাকে।
গত মঙ্গলবার ও গতকাল শনিবার রাতে দুই দফায় পলাশী যান এই প্রতিবেদক। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সব দোকান বন্ধ। ভাসমান কয়েকজন সিগারেট বিক্রেতা ঘুরাঘুরি করছেন। কয়েকজন তাঁদের ঘিরেই দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। তাঁদের একজন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পলাশী কয়েক দিন আগেও গমগম করত। কিন্তু এখন শূন্য।’ পলাশীর পরোটার দোকানের মালিক মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘১৯৮৮ সাল থেকে দোকান করি। এভাবে কখনো কেউ দোকান বন্ধ করেনি।’
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি তুহিন কান্তি দাস এটিকে ‘প্রশাসনের রক্ষণশীলতার প্রকাশ’ হিসেবে দেখছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আড্ডার জায়গাগুলো সংকুচিত হচ্ছে। ছাত্রদের খোলামেলা আলাপচারিতার জায়গাগুলো প্রশাসন সহ্য করতে পারছে না। উন্নয়নকাঠামো ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির নামে আড্ডার জায়গাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। সামগ্রিক বিষয়টি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের রক্ষণশীল করার চেষ্টা। এটা ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।’ এ প্রসঙ্গে তিনি ছবির হাট, মঙ্গল, ফুলার রোড—এসব জায়গার দোকান ও আড্ডা তুলে দেওয়ার কথা বলেন।
অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নামে ২০১৪ সালে হুট করে বন্ধ করে দেওয়া হয় চারুকলার উল্টোদিকে তরুণ শিল্পীদের আড্ডার জায়গা ‘ছবির হাট’। এরপর মাদক রোধের কথা বলে সন্ধ্যার পর সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান বন্ধ করা হয়। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উদ্যান বন্ধ হলেও মাদক বন্ধ হয়নি।
দু-এক বছর আগেও ছাত্ররা রাতে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) আশপাশে আড্ডা দিতেন। কিন্তু সেখান থেকে ভাসমান দোকানগুলো সরিয়ে দেওয়ার পর থেকে পলাশী হয়ে ওঠে আড্ডাপ্রেমীদের ‘একমাত্র’ গন্তব্য। তুহিন কান্তি দাস বলেন, পয়লা বৈশাখে নারী লাঞ্ছনার ঘটনার পর সেটার কোনো সমাধান না করে সিদ্ধান্ত হয় যে বিকেল পাঁচটার পর কোনো অনুষ্ঠান করা যাবে না। এভাবে সবকিছু ক্রমাগত শৃঙ্খলার মোড়কে ঢেকে দেওয়া হচ্ছে।
এডিসি নাজির আহমেদ খান বলেন, ‘ছাত্রদের রাতে আড্ডা দিতে হবে কেন? দিলেও টিএসসি বা ক্যাম্পাসের ভেতরে অন্য জায়গায় দেবে। এখানে বহিরাগতরাও আসে। এখানে দোকান থাকলে ছাত্রদেরই তো বেশি অসুবিধা হওয়ার কথা।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক এম আমজাদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, পলাশীর মোড়ের দোকানপাট বন্ধের পেছনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।