বন্ধু তুমি, শত্রু তুমি

শুরুতে একটা প্রশ্ন। শেষ কবে ফেসবুক থেকে লগ আউট করেছিলেন? দিনের বেশির ভাগ সময় ফেসবুকে ‘অনলাইন’ থাকার দলও বেশ ভারী। সেই সূত্রে এই প্রশ্ন নিয়ে সম্প্রতি ফেসবুকে বেশ হাসাহাসিও (মিম) হয়েছে। 

কিন্তু এই ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ বাদে আর কী হচ্ছে? এ দেশের তরুণেরা বলছেন, হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। একে অন্যের সঙ্গে সামাজিক মিথস্ক্রিয়া সতেজ থাকছে, ফিকে হচ্ছে না। খবরও মিলছে হরেক রকমের। আবার তরুণেরা এও বলছেন যে এসব খবরের সিংহভাগই ‘রং লাগানো’। রংবেরঙের ‘মিথ্যা’ খবর বাতাসের চেয়ে দ্রুতগতিতে ছড়িয়েও দিচ্ছে ফেসবুক। আর ভার্চ্যুয়াল সমাজের এত কিছুতে বুঁদ হয়ে তরুণেরা পড়াশোনায় খেই হারাচ্ছেন। 

প্রথম আলোর তারুণ্য জরিপে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। জরিপে অংশ নেওয়া তরুণেরা কিছু বিষয়ে বয়স-লিঙ্গ-শিক্ষানির্বিশেষে একমত হয়েছেন। তাঁরা বলছেন, নানাবিধ খবর পাওয়া, খবরের আদান–প্রদান, একে অপরের সঙ্গে যুক্ত থাকা এবং অনেক দিন আগে হারিয়ে ফেলা বন্ধুদের খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জুড়ি নেই। এমনকি এই মাধ্যম ব্যবহার করে যেকোনো সামাজিক অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে একজোটও হওয়া যায়। তরুণদের মতে, এগুলোই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ইতিবাচক দিক। এমন ইতিবাচক ভূমিকার কথা বলেছেন জরিপে অংশ নেওয়া ৯০ শতাংশের বেশি তরুণ। এর মধ্যে বন্ধুদের খুঁজে পাওয়ার পাল্লা সবচেয়ে ভারী। প্রায় ৯০ শতাংশ তরুণ ফেসবুক-ইউটিউব-ইমো থেকে নানা সংবাদ পান বলেও জানিয়েছেন। 

আর সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে একজোট হতে এসব মাধ্যমের ভূমিকায় প্রায় ৭৫ শতাংশ তরুণ আস্থাশীল। এর মধ্যে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীরা বেশি উৎসাহী। 

অবশ্য ইতির উল্টো পিঠেই থাকে নেতি। জরিপে অংশ নেওয়া ৮০ শতাংশের বেশি তরুণ মনে করেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তাঁদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে। শহুরে তরুণদের মধ্যে এই ভাবনা বেশি।

 প্রায় ৭৫ শতাংশ তরুণ মনে করছেন, ফেসবুক-ইউটিউবের দৌরাত্ম্যে শিশুরা খেলাধুলা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। মুখ গুঁজে থাকছে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে।

আবার বড়রা ভার্চ্যুয়াল সামাজিক জীবন ঠিক রাখতে গিয়ে, বাস্তবের সামাজিক অনুষ্ঠানে অসামাজিক তকমা পাচ্ছেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও মোবাইল ফোনে মুখ গুঁজে থাকছে মানুষ। এই পরিস্থিতির জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে দুষছে ৬৮ দশমিক ১ শতাংশ তরুণ। আর প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৬ জনের বেশি তরুণ বলেছেন, ফেসবুক-ইউটিউব-হোয়াটসঅ্যাপের বাড়-বাড়ন্তে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে পড়ছে, সবাই হয়ে পড়ছে অন্তর্মুখী। শহরে এই প্রবণতা তুলনামূলক বেশি। 

৭০ শতাংশের বেশি তরুণের বক্তব্য, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতারণা করে এবং ‘ফেক নিউজ’ ছড়ায়। 

দুই বছর আগেও এমন জরিপের আয়োজন করেছিল প্রথম আলো। ২০১৭ সালের সেই জরিপের তুলনায় এবার বেশ কিছু লক্ষণীয় পরিবর্তন এসেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেক নিউজ ছড়ায়—এ বিষয়ে তরুণদের ঐকমত্য বেড়েছে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ। আবার অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে একজোট হওয়ার মঞ্চ হিসেবে ফেসবুক-টুইটারের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে ১২ দশমিক ৪ শতাংশ। শিশুরা যে খেলার মাঠ ছেড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝুঁকছে, সেই বিষয়ে একমত হওয়ার হার বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ।

অফিসের কাজের ফাঁকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ। মডেল পমি। ছবি: সুমন ইউসুফ

তরুণদের অভিমত, হতাশায় ডুবে যাওয়া ও মাদকাসক্তির পেছনেও ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যোগসূত্র আছে। এমনকি প্রতারণা, ধর্ষণ, সাইবার অপরাধের প্রবণতা বাড়ার অন্যতম কারণ হিসেবেও ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে দায়ী করা হচ্ছে। জরিপে উঠে এসেছে, সদ্য তরুণেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। 

অবশ্য জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের একটি অংশ মনে করছেন, তাঁরা ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভালো সময়ও কাটাচ্ছেন। এটা পড়াশোনা থেকে শুরু করে চাকরির খোঁজখবর পেতেও সহায়তা করছে। ক্রমেই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ার অভিযোগ এই তরুণেরা মানছেন না। তাঁদের দাবি, শিক্ষা ও চাকরির প্রয়োজনে তরুণদের বাড়ি থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে। কর্মজীবী মা–বাবারা সন্তানদের প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারছেন না। এসব শূন্যস্থান পূরণ করছে ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। আর এসব থেকেই তৈরি হচ্ছে তরুণদের আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ার ‘ভুল’ দৃষ্টিভঙ্গি।

গুণগত জরিপে অংশ নেওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ার প্রবণতা তরুণদের পাশাপাশি সব বয়সী মানুষের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে। খেলাধুলার সুযোগ কম থাকা এবং শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটির কারণে তরুণেরা ফেসবুক-ইউটিউবে বেশি ঝুঁকছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ফাঁদ থেকে বের হওয়ার সমাধানও তরুণদের হাতে। ভালো-মন্দের ফারাক তরুণদের বুঝতে হবে। এ ক্ষেত্রে মা–বাবাকে বেশি উদ্যোগী হতে হবে। পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করতে হবে। এর জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তি থেকে মা–বাবাকে আগে বের হয়ে আসতে হবে। সন্তানদের সময় দেওয়ার পাশাপাশি তাদের ইন্টারনেট ব্যবহারেও কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে।