ঈদে বাড়ি যাব। তাই শুরু হলো টিকিটযুদ্ধ। রেলওয়ের অ্যাপে, অনলাইনে, স্টেশনে ঢুঁ মেরে যখন হতাশ, তখন বড় ভাই আমার হয়ে নামলেন যুদ্ধে। অসীম ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে অ্যাপে মিলল ঢাকা টু রাজশাহীর বিরতিহীন ট্রেন বনলতার টিকিট। মনে হলো যেন সোনার হরিণই পেলাম।
আট বছরের মেয়েকে নিয়ে আমার ঈদযাত্রা ছিল সোমবার, ৩ জুন বেলা সোয়া একটায়। ১ জুন থেকেই উত্তরবঙ্গগামী ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়ের খবর আসছিল। তবে বনলতা ছাড়ছিল ঠিক সময়েই। তারপরও দুরুদুরু বুকে মালপত্র আর মেয়েকে নিয়ে হাজির হলাম স্টেশনে।
নাহ কপাল মন্দ নয়। সোয়া একটার ট্রেন এল মাত্র মিনিট পাঁচেক দেরিতে। ১টা ২৮ মিনিটে ট্রেন ছাড়ল কমলাপুর স্টেশন থেকে। ভিড় নেই। মনে মনে ভাবলাম, যাক স্বস্তি। বুঝিনি অস্বস্তি আসবে অন্যদিক থেকে।
বনলতা ৪ ঘণ্টাতেই পৌঁছানোর কথা। তাই সঙ্গে ইফতার নিইনি। মেয়ের টুকটাক কিছু খাবার সঙ্গে। বিমানবন্দর স্টেশন পার হলো। কিছু পরে দেখলাম দরজার কাছে দাঁড়ানো মানুষ। কামরায় প্রায় ২০-২৫ জন। বোঝা গেল তাঁরা এভাবে দাঁড়িয়েই রাজশাহী যাবেন। পাশের কামরাতেও একই অবস্থা। তার মানে সব কামরাতেই এমন স্ট্যান্ডিং টিকিটের যাত্রী যাচ্ছেন। তবু মেনে নিলাম। ঈদের সময় নন এসিতে ঠাসাঠাসি অবস্থা হয়। এটুকু তো হতেই পারে।
জয়দেবপুরে এসে হঠাৎ থেমে গেল ট্রেন। জয়দেবপুরে যাত্রাবিরতির কথা নয়। ভাবলাম কিছু পরেই ছাড়বে। কিন্তু ট্রেন ছাড়ল ৪৫ মিনিট পর। একটি ট্রেন ক্রস করার পর। কয়েকজন যাত্রী বললেন, তিন দিন ধরে এভাবেই ক্রসিংয়ের জন্য থামছে বনলতা। চার ঘণ্টার বদলে সময় লাগছে ৭-৮ ঘণ্টা।
জয়দেবপুরের পরে আবার বনলতা বিরতি দিল টাঙ্গাইলে। সেখানে ২০-৩০ মিনিট। পার হলো আরেকটি ট্রেন। সম্ভবত গেল রংপুরগামী লালমণি এক্সপ্রেস।
এরপর বঙ্গবন্ধু সেতু। ততক্ষণে ইফতারের সময় কাছে এসেছে। কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিল, বনলতায় খাবার গাড়ি নেই। ইফতার কেনার জন্য ট্রেন থামবে। যাত্রীরা যেন ইফতার কিনে নেন। সিডিউল অনুযায়ী সাড়ে পাঁচটায়ই রাজশাহী পৌঁছানোর কথা। অথচ তখন ট্রেন যমুনা সেতুর কাছে। কেবল অর্ধেক পথ। সে জন্য কোনো দুঃখ প্রকাশ করার প্রয়োজন মনে করল না কর্তৃপক্ষ। বঙ্গবন্ধু সেতুতে কলা, ডিম, বাদাম থেকে শুরু করে একের পর এক হকার উঠতে শুরু করল। ইফতার কিনতে ব্যয় হলো ২০ মিনিটের মতো।
আবার ট্রেনের চলা শুরু। এরপরের বিরতি সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ স্টেশন। সেখানেও পার হলো আরেকটি ট্রেন। গেল আরও ২০ মিনিটের মতো।
এর মধ্যে যাত্রীদের বিরক্তি চরমে। ফাঁকা রাস্তায় বাস যেতে দেখে অনেকেই আফসোস করছেন। মাসুম নামে এক যাত্রী জানালেন, ২ জুন তাঁর ভাই রাজশাহী পৌঁছেছেন সাড়ে ৬ ঘণ্টায়। কারণ এই ক্রসিং।
আশিক নামে এক যাত্রী বললেন, বিরতিহীন ট্রেন কেন অন্য ট্রেনের ক্রসিংয়ের জন্য অপেক্ষা করবে? বিরতিহীন ট্রেনের জন্য অন্যগুলো অপেক্ষায় থাকতে পারে। ট্রেনের অ্যাটেনডেন্ট ও টিটির কাছে এত বিরতির কারণ জানতে চাইলাম। মনে হলো যেন উত্তর দিলে তাঁদের সময়ের অপচয় হবে। তাঁরা চলে গেলেন মহাব্যস্ততার সঙ্গে। দেখলাম দাঁড়ানো যাত্রীদের কাছ থেকে তাঁরা টাকা নিচ্ছেন। বাহ বেশ তো। এটাই তো জরুরি।
আন্তনগর ও বিরতিহীন হিসেবে বনলতার গতিও তুলনামূলক ধীর। প্রতি আসনের ওপরে ফ্যানের ব্যবস্থা নেই। সামনে পেছনের দুই সারি আসনের জন্য একটি ফ্যান। সেটি কোনদিকে বাতাস দেবে, তা নিয়ে যাত্রীদের মধ্য কলহ চলছে।
গরম আর বিরক্তি যখন চরমে, তখন ট্রেন রাজশাহীতে পৌঁছাল রাত আটটায়। যাত্রীদের একজন বললেন, কেবল ঈদযাত্রা নয়। তানিয়া নামের এক যাত্রী বললেন, বনলতা ২৫ মে তেও ৫ ঘণ্টায় রাজশাহী পৌঁছেছে। তিনি ওই দিন এসেছেন।
গন্তব্যে পৌঁছে যাত্রীরা কেউ চরম বিরক্ত। কেউ ভাবছেন, এ তো মন্দের ভালো। অন্য ট্রেন যখন স্টেশন থেকে ছাড়ছেই ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা দেরিতে, তখন তিন ঘণ্টা লেট আর এমন কী। ঈদে বনলতা না হয় এমন বিরতি নিলই।