রঙিন বাতিতে আলো ঝলমলে পাঁচতলার বাসা। ভেসে আসছে ঢাকঢোল আর সানাইয়ের সুর। বাসার সিঁড়ি ও ভেতরে আঁকা হয়েছে আলপনা। আত্মীয়স্বজন আর অতিথিদের সরগরমে বাসাজুড়ে উৎসবমুখর পরিবেশ। বাসার ছাদে পারিবারিক মন্দিরে চলছে বিয়ের আয়োজন। সাজানো হয়েছে বর-কণে। কন্যা সম্প্রদানের জন্য প্রস্তুত পরিবারের লোকজন। বিয়ে সম্পন্ন করার জন্য ডেকে আনা হয়েছে পুরাহিতকে।
৪০০ অতিথি নিমন্ত্রণের জন্য ছাপানো হয়েছিল বিয়ের কার্ড। এসব অতিথির প্রীতিভোজের জন্য বাড়িতেই চলছে রান্নাবান্না। অতিথিদের জন্য বসার ব্যবস্থা ছিল। অপেক্ষা শুধু শুভলগ্নের। গতকাল শনিবার সন্ধ্যা সাতটায় ঘনিয়ে এল সেই লগ্ন। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী সম্পন্ন হলো বিয়ে। হলো শুভদৃষ্টিও। বাবা লিটন পোদ্দার অশ্রসিক্ত নয়নে কন্যা সম্প্রদান করেন। বাড়ির আদরের কন্যাকে বিদায় দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন দিদিমা সবিতা পোদ্দার।
বগুড়া শহরের কাটনারপাড়া বেণীকুণ্ড লেনের পোদ্দারবাড়িতে (স্বপ্নের নীড়) একটি বিয়ে উপলক্ষে গতকাল সন্ধ্যায় এমন পরিবেশ বিরাজ করছিল। বিয়ে উপলক্ষে এত সব আয়োজন থাকলেও পাত্রপাত্রী হিসেবে বাস্তবে কোনো ছেলেমেয়ে ছিলেন না। বাসার ছাদে একসঙ্গে বেড়ে ওঠা দুটি বট ও পাকুড় গাছের ধুমধাম করে বিয়ে দিতে গিয়ে এত সব আয়োজন করা হয়। আর আলোচিত এই বিয়ের অনুষ্ঠান দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে আসা মানুষের ঢল নামে।
বাসার গৃহকর্ত্রী ও জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী সবিতা পোদ্দার বলেন, ১৪ বছর ধরে বাসার ছাদের বাগানে পাকুড়গাছের সঙ্গে অঙ্গ জড়িয়ে বটগাছটি বেড়ে উঠেছে। দুটোই ধর্মবৃক্ষ। মন্দিরের পুরোহিতের পরামর্শে ধুমধাম করে তাদের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রোববার বর-কনেকে নিয়ে যাওয়া হবে করতোয়া নদীর তীরে কদমতলী মন্দিরে। সেখানেই তাদের প্রতিস্থাপন করা হবে।
সবিতা পোদ্দার আরও বলেন, ১৬ বছর আগে বড় মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে বাড়িতে ধুমধাম পড়ে গিয়েছিল। আজ বাড়ির ছোট মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে একই উৎসব-আমেজ বিরাজ করছে।
বাড়ির ছোট ছেলে ও ব্যবসায়ী লিটন পোদ্দার বলেন, ‘পাঁচতলা বাসার ছাদের এক পাশে পারিবারিক রাধাগোবিন্দ মন্দির। অন্য পাশে ফুল ও ফলবাগান। বাগানটা দেখভাল করেন মা সবিতা পোদ্দার। দেড় বছর আগে পাকুড়গাছের সঙ্গে জড়ানো বটগাছটি মায়ের নজরে আসে। দুটোই দেবতা বৃক্ষ হওয়ায় বিষয়টি জানানো হয় পুরোহিত শিবপ্রসাদ চক্রবর্তী ও দেব ভট্টাচার্যকে। তাঁরা দুজনই বট-পাকুড়ের বিয়ে দেওয়ার কথা বলেন। এরপর বটবৃক্ষের নাম রাখা হয় লাবণ্য পোদ্দার ও পাকুড়ের নাম রাখা হয় সার্থককুণ্ড পোদ্দার ওরফে পল্লব। লাবণ্য বড় হতে থাকে আমার মেয়ে এবং পোদ্দারবাড়ির ছোট কন্যা হিসেবে।’
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সারাতে আসা পুরোহিত শিবপ্রসাদ চক্রবর্তী বলেন, বরের বয়স ১৪। কনের ১২। তারা একসঙ্গে বড় হয়েছে। বট ও পাকুড় বৃক্ষ হিন্দুশাস্ত্রে দেবতা বৃক্ষ। পূজাতেও এই দুটি গাছ লাগে। এ কারণে বট-পাকুড়ের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
আলোচিত এই বিয়ের অনুষ্ঠান দেখতে গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার ধারাবর্ষা গ্রাম থেকে আসা মাছ ব্যবসায়ী বিষ্ণুপদ দাস বলেন, ‘বট-পাকুড়ের বিয়ের কথা এত দিন শুনে এসেছি। পরিচিত একজনের কাছে বিয়ের নিমন্ত্রণের কার্ড দেখে কৌতূহলী হয়েই বিয়েবাড়িতে এসেছি। এত সব আয়োজন দেখে হতবাক।’
শহরের বাদুরতলা থেকে বিয়ের নিমন্ত্রণ খেতে আসা সুলতি বড়াল (৬৫) বলেন, ‘পোদ্দারবাড়ির কন্যা আমি। এ বাড়িতে ১৬ বছর আগে কণিকা পোদ্দারের বিয়েতে এসে যে উৎসবমুখর পরিবেশ দেখেছিলাম, আজ বাড়ির ছোট মেয়ে (বটগাছ) লাবণ্য পোদ্দারের বিয়েতেও একই দৃশ্য দেখেছি।’