রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন

বঙ্গবন্ধুর খুনির নাম লুকিয়ে সন্তানদের পাসপোর্ট

মোসলেহ উদ্দিন
মোসলেহ উদ্দিন

বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি রিসালদার (বরখাস্ত) মোসলেহ উদ্দিনের ছয় সন্তান তাঁদের বাবার নাম মো. রফিকুল ইসলাম খাঁন হিসেবে উল্লেখ করে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নিয়েছেন। এরপর একই জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে তাঁদের তিনজন পাসপোর্ট ও একজন ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়েছেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালানো দলটির সামনের সারিতে ছিলেন মোসলেহ উদ্দিন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচার শুরু করলে মোসলেহ উদ্দিন আত্মগোপন করেন। এখন তাঁর অবস্থান কোথায়, তা নিয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই।

মোসলেহ উদ্দিনের সন্তানেরা যে বাবার নাম রফিকুল ইসলাম খাঁন উল্লেখ করে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট নিয়েছেন, তা সরকারকে জানিয়েছে সরকারেরই একটি সংস্থা। পরবর্তী সময়ে প্রথম আলো আরও অনুসন্ধান চালিয়ে তিন সন্তানের পাসপোর্টের নথি সংগ্রহ করে। এতেও দেখা যায়, তাঁরা বাবার নামের জায়গায় মো. রফিকুল ইসলাম খাঁন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মায়ের নামের জায়গায় মমতাজ বেগমই লেখেন।

পাসপোর্ট নিয়েছেন তিন সন্তান। একজন নিয়েছেন ড্রাইভিং লাইসেন্স। সন্তানদের একজন দাবি করেছেন, তাঁদের ছোটবেলা থেকেই বাবার নাম রফিকুল ইসলাম খাঁন ব্যবহৃত হয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্র আইন ও পাসপোর্ট অধ্যাদেশে তথ্য লুকানো দণ্ডনীয় অপরাধ।

মোসলেহ উদ্দিনের ছয় সন্তান হলেন মো. সাজিদুল ইসলাম খাঁন, সানাজ খাঁন, মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম খান, মাহমুদুল ইসলাম খান, মজিদুল ইসলাম খান ও মো. মহিদুল ইসলাম খান। এঁরা সবাই বাবার নাম রফিকুল উল্লেখ করে জাতীয় পরিচয়পত্র নেন। এর মধ্যে সাঁনাজ খান, মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম খান ও মো. মহিদুল ইসলাম খান পাসপোর্ট নিয়েছেন। ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়েছেন মাহমুদুল ইসলাম খান।

নথিপত্র অনুযায়ী, সাঁনাজ খান পাসপোর্ট পান ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর। মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম খান পাসপোর্ট নেন ২০১৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি। আর মো. মহিদুল ইসলাম খান পাসপোর্ট পান ২০১৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর।

মোসলেহ উদ্দিনের ছোট ছেলে মহিদুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের জন্মের পর থেকেই বাবার নামের জায়গায় রফিকুল ইসলাম খাঁন ব্যবহার করা হয়েছে, মোসলেহ উদ্দিন নয়। তাঁদের শিক্ষাসংক্রান্ত সব নথিপত্রে বাবার নামের জায়গায় রফিকুল ইসলাম খাঁন লেখা হয়েছে। তিনি নিজের ২০০০ সালের এসএসসি পরীক্ষার সনদ ছবি তুলে পাঠান, যেখানে বাবার নামের জায়গায় রফিকুল ইসলাম খাঁন রয়েছে বলে দেখা যায়।

আমাদের কাছে মোসলেহ উদ্দিনের ছয় সন্তানের বাবার নাম বদলের তথ্য বা অভিযোগ আসেনি। এলে বুঝতে পারব, কীভাবে হয়েছে। অভিযোগ পেলে বিষয়টি খতিয়ে দেখব।
এ কে এম হুমায়ূন কবীর, জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক

মহিদুল ইসলাম খান আরও বলেন, ২০১৯ সালের তাঁদের নথিপত্র পুলিশের পক্ষ থেকে তদন্ত করা হয়েছিল। সেখানে তাঁরা বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। তিনি একজন পুলিশ কর্মকর্তার নাম বলেন, যিনি বিষয়টি তদন্তের দায়িত্বে ছিলেন।

মহিদুল ইসলাম যে পুলিশ কর্মকর্তার বরাত দেন, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় প্রথম আলোর পক্ষ থেকে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মোসলেহ উদ্দিনের পাঁচ সন্তানের শিক্ষাসংক্রান্ত নথিতে বাবার নাম রফিকুল ইসলাম খাঁন পাওয়া যায়। তবে বড় ছেলে বাবার নাম পরিবর্তন করেছেন। কারণ, তিনি শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কোনো নথি দেখাতে পারেননি। তিনি বলেন, এ-সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন তিনি জমা দিয়েছিলেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালে মোসলেহ ‍উদ্দিনের নামে পাসপোর্ট বাতিল করে। তার মানে হলো, ওই সময় পর্যন্ত মোসলেহ উদ্দিনের নামে পাসপোর্ট ছিল। কিন্তু তাঁর সন্তানেরা এর আগে থেকেই বাবার ভিন্ন নামে পরিচিত হন এবং জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট সংগ্রহ করেন। উল্লেখ্য, ২০০৮ সালে দেশে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা করা হয়। পরে এই ভোটার তালিকার ভিত্তিতে জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া শুরু হয়।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সেনা গেজেটে মোসলেহ উদ্দিন খানের নাম রয়েছে। তাঁর নামে গেজেট জারি করা হয় বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের শাসনামলে, ২০০৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর। তাঁর বাবার নাম আব্দুল হক খান। জেলা নরসিংদী, থানা শিবপুর, গ্রাম দত্তেরগাঁও।

জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন অনুযায়ী, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বা জ্ঞাতসারে কোনো মিথ্যা বা বিকৃত তথ্য দেওয়া অথবা তথ্য গোপন করার শাস্তি অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড। কোনো ব্যক্তি জাতীয় পরিচয়পত্র জাল করলে তিনি সাত বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফিরিয়ে আনতে গঠিত কমিটির গত ৯ অক্টোবরের বৈঠকের কার্যবিবরণীতে বলা হয়, মোসলেহ উদ্দিনের নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার দত্তেরগাঁওয়ে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ৪৫ শতাংশের মতো বাড়ির ভিটাসহ নাল জমি রয়েছে। বৈঠকে নরসিংদীর পুলিশ সুপার জানিয়েছিলেন, মোসলেহ উদ্দিন বিষয়ে তাঁরা কোনো খোঁজ পাননি। বর্তমানে তাঁর সম্ভাব্য অবস্থান ভারত। অবশ্য স্থানীয় ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, মোসলেহ উদ্দিনের সন্তানদের কেউ কেউ নরসিংদীতে বাস করেন। সেখানে তাঁরা মোসলেহ উদ্দিনের সন্তান নামেই পরিচিত।

মোসলেহ উদ্দিনসহ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার পাঁচ আসামি এখন পলাতক রয়েছেন। ছয়জনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। সর্বশেষ ফাঁসি কার্যকর হয় আবদুল মাজেদের, যিনি গত বছরের ৭ এপ্রিল গাবতলী থেকে গ্রেপ্তার হন। মোসলেহ উদ্দিনকে গত বছর ভারত ধরার পর বাংলাদেশের গোয়েন্দাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছিল ভারতীয় একটি পত্রিকা। তবে তা পরে সত্য প্রমাণিত হয়নি।

সরকার ২০১৬ সালে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে সম্পদ এখনো বাজেয়াপ্ত করা হয়নি, কাজ চলছে। এদিকে গত ৯ ফেব্রুয়ারি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) সভায় মোসলেহ উদ্দিনের রাষ্ট্রীয় খেতাব বাতিলের সুপারিশ করা হয়।

পরিচয় লুকানো অপরাধ
জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন অনুযায়ী, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বা জ্ঞাতসারে কোনো মিথ্যা বা বিকৃত তথ্য দেওয়া অথবা তথ্য গোপন করার শাস্তি অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড। কোনো ব্যক্তি জাতীয় পরিচয়পত্র জাল করলে তিনি সাত বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই ভাবে পাসপোর্ট অধ্যাদেশেও এ ধরনের অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ছয় মাসের কারাদণ্ড বা দুই হাজার টাকা জরিমানা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক এ কে এম হুমায়ূন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের কাছে মোসলেহ উদ্দিনের ছয় সন্তানের বাবার নাম বদলের তথ্য বা অভিযোগ আসেনি। এলে বুঝতে পারবেন কীভাবে হয়েছে। অভিযোগ পেলে বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন।