বগুড়া পৌরসভা নির্বাচনে নারী ভোটারদের দীর্ঘ সারি। গত রোববার সকালে বগুড়া শহরের ঠনঠনিয়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে
বগুড়া পৌরসভা নির্বাচনে নারী ভোটারদের দীর্ঘ সারি। গত রোববার সকালে বগুড়া শহরের ঠনঠনিয়া মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে

বগুড়া পৌরসভার ভোট বিশ্লেষণ

নৌকার শোচনীয় হারের তিন কারণ

বগুড়া পৌরসভা নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে হেরেছেন মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবু ওবায়দুল হাসান। ভোটের হিসাবে তিনি বিজয়ী বিএনপি প্রার্থীর দূরের কথা, দ্বিতীয় হওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরও ধারেকাছে ভিড়তে পারেননি। পরাজয়ের পেছনে তিনটি কারণকে সামনে আনছেন নেতা-কর্মীরা—উপযুক্ত প্রার্থী দিতে না পারা, ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীকে বসাতে দৃশ্যমান তৎপরতার অভাব এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলরের পদগুলোতেও দলীয় সমর্থন দেওয়া।

আবু ওবায়দুল হাসান। বগুড়া পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে শোচনীয়ভাবে হেরেছেন

নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ফলাফলে দেখা গেছে, বগুড়া পৌরসভা নির্বাচনে ৫৯ দশমিক ৮৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। মেয়র পদে রেজাউল করিম ধানের শীষ প্রতীকে পেয়েছেন ৮২ হাজার ২১৭ ভোট (মোট ভোটের ৪৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ)। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী (আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী) আবদুল মান্নান আকন্দ। তিনি জগ প্রতীকে পেয়েছেন ৫৬ হাজার ৯০ ভোট (৩৪ শতাংশ)। আর নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আবু ওবায়দুল হাসান পেয়েছেন ২০ হাজার ৮৯ ভোট (১২ শতাংশ)। অর্থাৎ রেজাউলের চেয়ে ৬২ হাজার ১২৮ ভোট আর মান্নানের চেয়ে ৩৬ হাজার ১ ভোট কম পেয়েছেন ওবায়দুল। নিয়মানুযায়ী, মোট পড়া ভোটের ৮ শতাংশ না পাওয়ায় জামানত হারাচ্ছেন তিনি।

আবদুল মান্নান আকন্দ। বগুড়া পৌরসভা নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন আওয়ামী লীগের এই নেতা। দলীয় প্রার্থীর চেয়ে ভোট পেয়েছেন অনেক বেশি

ভোটের হিসাবে আরও দেখা যাচ্ছে, ২০১১ ও ২০১৬ সালের নির্বাচনের তুলনায় এবার আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয় দলেরই ভোট কমেছে। তবে বেশি কমেছে আওয়ামী লীগের ভোট। জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল করিম ওই দুটি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হয়েছিলেন। তিনি নৌকা প্রতীকে যথাক্রমে ৫৯ হাজার ৩৫৫টি ও ৪৯ হাজার ৪১৭টি ভোট পান। এবার রেজাউল করিমের বদলে দলীয় মনোনয়ন পান শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল হাসান। সর্বশেষ ২০১৬ সালের সঙ্গে তুলনা করলেও এবার নৌকায় ২৯ হাজার ৩২৮টি ভোট কম পড়েছে (৪০ দশমিক ৬৫ শতাংশ কম)।

২০১১ সালের বগুড়া পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন দলের চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এ কে এম মাহাবুবর রহমান। সেবার তিনি ৯৬ হাজার ৩৩৪ ভোট পেয়ে জয়ী হন। ২০১৬ সালের নির্বাচনে তাঁর ভোট বেড়ে হয় ১ লাখ ৭ হাজার ৩৪০টি। এবার ধানের শীষের প্রার্থী হন জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি রেজাউল করিম। গতবারের সঙ্গে তুলনা করলে তিনি ২৫ হাজার ১২৩ ভোট কম পেয়েছেন। অর্থাৎ বিএনপিরও ভোট কমেছে উল্লেখযোগ্য।
এ বিষয়ে বিজয়ী রেজাউল করিম বলেন, ধানের শীষের বিরুদ্ধে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী লাগাতার ‘অপপ্রচার’ ও কালো টাকা ছড়িয়ে ভোটারদের বিভ্রান্ত করেছেন। তা না হলে আরও বিপুল ভোটে জয়লাভ করতে পারতেন তিনি। তারপরও সার্বিক ভোটের হিসাবে বিএনপির জনপ্রিয়তা কমেনি।

যা বলছেন আ.লীগের নেতারা
সারা দেশে পৌরসভা নির্বাচনে প্রায় সবখানে জিতেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। কিন্তু বগুড়ায় উল্টো চিত্র। দলীয় নেতা-কর্মীরা এমন শোচনীয় পরাজয়ের পেছনের কারণগুলো খুঁজে ফিরছেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে মোটা দাগে তিনটি কারণ বেরিয়ে আসছে—উপযুক্ত প্রার্থী দিতে স্থানীয় নেতৃত্বের ব্যর্থতা, বিদ্রোহী প্রার্থীকে বসাতে না পারা এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলরের পদগুলোতেও দলীয় সমর্থন দেওয়া।
বগুড়া শহর আওয়ামী লীগের নেতা অ্যাডোনিস বাবু তালুকদারের মতে, নৌকার ভরাডুবির জন্য দায়ী দলীয় প্রার্থী নির্বাচনে ভুল সিদ্ধান্ত। আবু ওবায়দুল হাসান শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হলেও ভোটারদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল কম। কোনো কোনো ভোটারের কাছে ‘অচেনা মুখ’ ছিলেন তিনি। ফলে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মীও দলের বিদ্রোহী প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন।

নেতা-কর্মীরা আরও বলছেন, অনেক সময় নতুন কেউ মনোনয়ন পেলেও দলকে জেতাতে পারেন। কিন্তু সে জন্য থাকতে হয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় করার দক্ষতা। সেই সক্ষমতাও দেখাতে পারেননি ওবায়দুল হাসান।

নেতা-কর্মীরা আরও বলছেন, অনেক সময় নতুন কেউ মনোনয়ন পেলেও দলকে জেতাতে পারেন। কিন্তু সে জন্য থাকতে হয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে কার্যকর সমন্বয় করার দক্ষতা। সেই সক্ষমতাও দেখাতে পারেননি ওবায়দুল হাসান। আর তাঁর বিপরীতে যিনি বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচনে রয়ে যান, সেই আবদুল মান্নান দলে বেশ প্রভাবশালী। তিনি শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। ‘হেভিওয়েট’ এই প্রার্থীকে বসাতে দলের দৃশ্যমান তৎপরতা ছিল না। নির্বাচনের কয়েক দিন আগে এসে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। অন্যদিকে নৌকার পক্ষে ভোট চাইতে সরকারের উন্নয়ন-কর্মকাণ্ড ভোটারের কাছে তুলে ধরতেও নেতারা ব্যর্থ হয়েছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক সুলতান মাহমুদ খান বলেন, ‘অসম্মানজনকভাবে নৌকার ভরাডুবির জন্য দলের নেতৃত্বই দায়ী। নৌকাকে জেতাতে আমাদের কারও সদিচ্ছা ছিল না। শেখ হাসিনার অর্জন ও সরকারের উন্নয়নবার্তা নিয়ে ভোটারের কাছে যেতে পারিনি আমরা। নামেই দল করি, কিন্তু দলের আদর্শ থেকে বিচ্যুত। দরদ দিয়ে কেউ দলকে ভালোবাসি না।’

বগুড়া পৌরসভা নির্বাচন চলাকালে সতর্ক অবস্থান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের। গত রোববার দুপুরে বগুড়া শহরতলির বেলাইল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে

তবে জেলা আওয়ামী লীগ বলছে, প্রার্থী মনোনয়নে দলের কোনো ভুল সিদ্ধান্ত ছিল না। পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির নেতা হিসেবেই ওবায়দুল হাসানকে বেছে নেয় দল। এমন প্রার্থীর হারের পেছনে নতুন এক কারণ সামনে আনছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসান। তিনি বলেন, নৌকার ভরাডুবির নেপথ্যে কার্যত দায়ী কাউন্সিলর পদে একজনকে দলীয় সমর্থন দেওয়া। প্রতিটি ওয়ার্ডেই দলের তিন-চারজন করে কাউন্সিলর পদপ্রার্থী ছিলেন। কাউকেই দলীয় সমর্থন না দিলে সবাই মেয়র পদে নৌকার পক্ষে কাজ করতেন। ২১টি ওয়ার্ডেই একজন করে দলীয় সমর্থন দেওয়ায় বঞ্চিত ব্যক্তিরা আর দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেননি।

বগুড়া পৌরসভা নির্বাচনে নৌকার শোচনীয় পরাজয়ে জেলা নেতৃত্বের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক (রাজশাহী বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত) এস এম কামাল হোসেন। তাঁর মতে, এ পরাজয়ের জন্য দলের স্থানীয় নেতৃত্ব আর সাংগঠনিক ব্যর্থতা দায়ী।
এস এম কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে আমি নিজেও ব্যর্থ। কারণ, বগুড়া আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে ধারণ করতে পারিনি। বগুড়ায় আওয়ামী লীগের অনেক কর্মী আছেন, অনেক ভোটও আছে। কিন্তু সেখানে ত্যাগী সংগঠক নেই। সেখানকার নেতারা শেখ হাসিনার আদর্শের রাজনীতি করেন না। তাঁরা দলীয় বিভেদ-বিভক্তি আর নিজেদের স্বার্থ নিয়েই বেশি ব্যস্ত। দলের স্বার্থ নিয়ে কেউ ভাবেন না। দলীয় নেতারা ঐক্যবদ্ধ ও আন্তরিক হলে নির্বাচনে জয়লাভ কোনো ব্যাপার নয়।’