বাংলাদেশ ও ফ্রান্স তাদের দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা জোরদারের জন্য ব্যবসা, বিনিয়োগ ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় জোর দিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গতকাল মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্যারিসে এলিসি প্রাসাদে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর সঙ্গে বৈঠকের পর দুই দেশ প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সম্মতিপত্রে সই করেছে। গতকাল প্যারিস থেকে কূটনৈতিক একটি সূত্র প্রথম আলোকে দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকের বিষয়ে এসব তথ্য জানিয়েছে।
সূত্র থেকে জানা গেছে, দুই দেশ প্রতিরক্ষা সহযোগিতার যে সম্মতিপত্র সই করেছে, তাতে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর দক্ষতা বাড়ানোর জন্য আধুনিক প্রশিক্ষণের পাশাপাশি প্রযুক্তি বিনিময়ের মতো বিষয়গুলো যুক্ত থাকছে। এরই ধারাবাহিকতায় দুই দেশ প্রতিরক্ষা সহযোগিতার নতুন কোনো আইনি কাঠামোতে যাওয়ার সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এই প্রতিবেদককে আভাস দিয়েছেন।
প্যারিসের সূত্রগুলো জানিয়েছে, ঢাকা-প্যারিস সম্পর্ককে পরের ধাপে উত্তরণের জন্য অর্থনৈতিক সহযোগিতা, বিশেষ করে ব্যবসা, বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়েও কথা বলেছেন। বছর দু-এক ধরেই বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিশেষ করে জঙ্গি বিমান রাফাল বিক্রির বিষয়টি সামনে এনেছে ফ্রান্স। গত বছর ঢাকায় এসে দাসো রাফাল বিক্রির বিষয়ে শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করেছিলেন ফ্রান্সের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফ্লোরেন্স পার্ল। আজ বুধবার প্যারিসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ফ্লোরেন্স পার্লের সৌজন্য সাক্ষাতের কথা রয়েছে। ফলে ওই আলোচনাতেও সমরাস্ত্র বিক্রির প্রসঙ্গটি আসবে।
দুই শীর্ষ নেতার বৈঠক শেষে প্রচারিত যৌথ ঘোষণায় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে এসেছে। দুই দেশ প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সহযোগিতা বাড়াতে একমত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়মিত আলোচনা ও প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হবে। প্রয়োজনে সামর্থ্য অনুযায়ী একপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী অন্য পক্ষ তা সরবরাহে সহযোগিতা করবে।
গতকাল সকালে লন্ডন থেকে প্যারিসে পৌঁছান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্যারিস সফরের প্রথম দিনেই এলিসি প্রাসাদে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর সঙ্গে মঙ্গলবার মধ্যাহ্ন ভোজসভায় মিলিত হয়েছেন। এরপর দুই শীর্ষ নেতা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারের বিষয়ে একান্তে আলোচনা করেন।
দুই শীর্ষ নেতার বৈঠক শেষে প্রচারিত যৌথ ঘোষণায় দুই দেশ তাদের এই সম্পর্কের একটি কৌশলগত দিক নির্দেশনা দেওয়ার লক্ষ্যে সহযোগিতার সব বিষয়ে নিয়মিতভাবে রাজনৈতিক আলোচনা আয়োজনের ওপর জোর দিয়েছে। দুই পক্ষ রাজনীতি, কূটনীতি, প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, টেকসই উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিনিময়সহ নানা ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ও ফ্রান্স সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামে সহযোগিতায় জোর দিয়েছে।
ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরকে ঘিরে ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা গত কয়েক বছর ধরে সারা বিশ্বকে ভাবিয়ে তুলেছে। প্রাসঙ্গিকভাবেই শেখ হাসিনা ও এমানুয়েল মাখোঁর বৈঠকে এই প্রসঙ্গটি এসেছে। যৌথ বিবৃতিতে দুই দেশ সবার সমৃদ্ধির লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক আইন সমুন্নত রেখে অবাধ, মুক্ত, শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ এবং অংশগ্রহণমূলক ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাঁচ দিনের সফরের প্রথম দিনেই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করতে এলিসি প্রাসাদে যান। এ সময় এলিসি প্রাসাদে পৌঁছালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানান ফরাসি প্রেসিডেন্ট। শেখ হাসিনাকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন ফ্রান্সের রিপাবলিকান গার্ডের সদস্যরা। পরে দুই শীর্ষ নেতা ফটোসেশনে অংশ নেন। এরপর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে এলিসি প্রাসাদের বৈঠকস্থলের দিকে এগিয়ে যান।
* সম্পর্ককে কৌশলগত পর্যায়ে নিতে নিয়মিত আলোচনায় অগ্রাধিকার। * যৌথ ঘোষণায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষায় গুরুত্বারোপ। * শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ ইন্দো-প্যাসিফিক প্রতিষ্ঠায় ঐকমত্য।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম বার্তা সংস্থা বাসসকে জানান, প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সফরসঙ্গীদের বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ভিভিআইপি ফ্লাইট (বিজি-২১০৬) গতকাল ফ্রান্সের সময় অনুযায়ী বেলা ১১টা ২০ মিনিটে চার্লস দ্য গল বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রীকে ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত খন্দকার মোহাম্মদ তালহা ও স্থানীয় প্রশাসনের প্রধান স্বাগত জানান।
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব জানান, দুই নেতার একান্ত আলোচনার পর তাঁদের উপস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার বিভিন্ন সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে।
পাঁচ দিনের প্যারিস সফরের সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন ফ্রান্সের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফ্লোরেন্স পার্ল। ওই আলোচনায় বাংলাদেশের কাছে জঙ্গি বিমান (রাফাল) বিক্রির বিষয়ে প্রাধান্য দেবেন ফ্রান্সের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। ফ্রান্সের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেটে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে।
খসড়া সফরসূচি অনুযায়ী, ফ্রান্সের ব্যবসায়ীদের অন্যতম সংগঠন মুভমেন্ট অব দ্য এন্টারপ্রাইজ অব ফ্রান্সের (এমইডিইএফ) উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১১ নভেম্বর সৃজনশীল অর্থনীতিতে অবদানের জন্য প্রবর্তিত ইউনেসকো-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রদান করবেন বিজয়ীকে। বঙ্গবন্ধুকে সম্মান জানাতে ২০২০ সালে বাংলাদেশের অর্থায়নে এই পুরস্কার প্রবর্তন করে ইউনেসকো। সফরের শেষ দিনে অর্থাৎ ১৩ নভেম্বর তিনি প্যারিস পিস ফোরামের সভায় অংশ নেবেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ইউনেসকোর ৭৫তম বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে।