রাজধানীতে মুঠোফোন ইন্টারনেটের গতি যে কম, তা এবার নিয়ন্ত্রণ সংস্থার জরিপেই উঠে এল। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) পরীক্ষা করে দেখেছে, ঢাকার গ্রাহকেরা চতুর্থ প্রজন্মের ইন্টারনেট সেবায় (ফোর-জি) ৩ থেকে ৬ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট পাচ্ছেন। অথচ, বিটিআরসির বেঁধে দেওয়া মান অনুযায়ী, গ্রাহকদের সর্বনিম্ন ৭ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট দেওয়ার কথা।
মুঠোফোন সেবার মান নিয়ে বিটিআরসি আজ বুধবার একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে এ নিম্নগতির চিত্র উঠে আসে। তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে বেসরকারি মুঠোফোন অপারেটরগুলো উতরে গেছে। শুধু সরকারি অপারেটর টেলিটক ছাড়া।
জরিপটি হয় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায়। ২৩ জানুয়ারি থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পরীক্ষা বা ড্রাইভ টেস্ট চালানো হয়। এতে যাচাই করা হয় যে বিটিআরসি ২০১৮ সালের সেবার মান বেঁধে দিয়ে যে বিধিমালা জারি করেছিল, সে অনুযায়ী অপারেটররা গ্রাহকদের সেবা দিচ্ছে কি না।
জরিপে উঠে আসে, ফোর-জিতে ডাউনলোড গতির ক্ষেত্রে গ্রামীণফোন ও রবি সমান সমান, ৫ দশমিক ৭২ এমবিপিএস (মেগাবিট পার সেকেন্ড)। বাংলালিংকে গতি ৪ দশমিক ৯৪ ও টেলিটকে ২ দশমিক ৮২ এমবিপিএস। বিটিআরসির সেবার মান নিয়ে বিধিমালায় বলা আছে, ফোর-জি সেবায় ডাউনলোডের গতি হতে হবে সর্বনিম্ন ৭ এমবিপিএস। অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রে কেউ শর্ত পূরণ করতে পারেনি।
ফোর-জিতে আপলোডের ক্ষেত্রে এক এমবিপিএসের চেয়ে বেশি গতি থাকতে হবে। বিটিআরসির জরিপ অনুযায়ী, এ ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে অপারেটরগুলো। গ্রামীণফোন ১০, রবি ১২ দশমিক ৬৯, বাংলালিংক ১০ দশমিক ৭২ ও টেলিটক ৪ দশমিক ৫২ এমবিপিএস গতিতে এ সেবা দেয়।
তৃতীয় প্রজন্মের ইন্টারনেট সেবার (থ্রি-জি) ক্ষেত্রে গতিতে টেলিটক ছাড়া বাকি তিন অপারেটর নির্ধারিত মানের চেয়ে ভালো সেবা দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিটিআরসি নির্ধারিত সর্বনিম্ন গতি ২ এমবিপিএসের বেশি। গ্রামীণফোনের গতি ৩ দশমিক ৯৬, রবির ৪ এর সামান্য কিছু বেশি, বাংলালিংকের ৩ দশমিক ৯৯ এবং টেলিটকের ১ দশমিক ৭৪ এমবিপিএস। অর্থাৎ, এ ক্ষেত্রে রবি সবার চেয়ে এগিয়ে আছে।
থ্রি-জিতে আপলোডের ক্ষেত্রে সব অপারেটরের গ্রাহক ভালো গতি পাচ্ছেন। গ্রামীণফোনে গতি ৭ দশমিক ৮৪, রবিতে ৯ দশমিক ৪৩, বাংলালিংকে ৮ দশমিক ৪৫ এবং টেলিটকে ২ দশমিক ৩১ এমবিপিএস।
কলড্রপ সীমার মধ্যেই
বিটিআরসির পরীক্ষায় উঠে আসে যে চার অপারেটরের কলড্রপের হারই নির্ধারিত সীমার মধ্যে রয়েছে। গ্রামীণফোনে কলড্রপের হার সবচেয়ে কম, শূন্য দশমিক ১৮ শতাংশ। এরপর রয়েছে বাংলালিংক শূন্য দশমিক ৩১, রবি শূন্য দশমিক ৩৭ এবং টেলিটক ১ দশমিক ৩১ শতাংশ। সেবার মান বিধিমালা অনুযায়ী, কলড্রপের হার ২ শতাংশের বেশি হতে পারবে না।
সংযোগে সফলতার ক্ষেত্রেও সব অপারেটর ভালো অবস্থানে আছে। কল সংযোগ সময়ের ক্ষেত্রে গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংক মান রক্ষা করতে পেরেছে। পারেনি শুধু টেলিটক।
উন্নতি হলো কি
বিটিআরসি ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে এমনই পরীক্ষা চালিয়েছিল। তখনকার পরীক্ষার সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, কলড্রপ পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে ইন্টারনেটের গতির ক্ষেত্রে নয়।
ওই জরিপে উঠে আসে, গ্রামীণফোনের কলড্রপের হার ছিল ৩ দশমিক ৩৮ শতাংশ, যা এখন অনেক কমেছে। অবশ্য রবি, বাংলালিংক ও টেলিটকের কলড্রপ আগেও বিটিআরসির সীমার মধ্যে ছিল। ২০১৮ সালের জরিপেও ফোর-জির ডাউনলোড গতি সব অপারেটরের ক্ষেত্রে ৬ এমবিপিএসের কম ছিল।
অপারেটরগুলো বলে আসছে, ইন্টারনেটের গতি বিষয়টি শুধু অপারেটরের ওপর নির্ভর করে না। এ জন্য টাওয়ার কোম্পানি, ফাইবার অপটিক কেব্ল, তরঙ্গসহ আরও কিছু বিষয় রয়েছে।
সেবার মান নিয়ে গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষ প্রথম আলোকে দেওয়া এক বিবৃতিতে আজ বলেছে, তাদের কলড্রপের হার এখন মাত্র শূন্য দশমিক ১৮ শতাংশ। গ্রাহকের উন্নততর অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করতে গ্রামীণফোন নেটওয়ার্ক আধুনিকায়ন, নতুন টাওয়ার বসানো, বাড়তি তরঙ্গ ব্যবহার করা এবং অপটিক্যাল ফাইবার যথাযথভাবে রাখা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু নানা উন্নয়নকাজে প্রায়ই ফাইবার কাটা পড়ে।
রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিটিআরসি পরিচালিত ড্রাইভ টেস্টে প্রাপ্ত মোবাইল ইন্টারনেটের গড় গতিকে আমরা যথেষ্ট ভালো বলে মনে করি। কারণ, একটি মোবাইলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে এইচডি মানের একটি ভিডিও দেখা অথবা অন্য যেকোনো প্রয়োজনীয় কাজের জন্য ৩ এমবিপিএস গতিই যথেষ্ট, সে তুলনায় ৫ দশমিক ৭ এমবিপিএস গড় গতি গ্রাহকদের প্রয়োজন পূরণে যথেষ্ট।’
তিনি বলেন, ‘আরও অধিক গতিসম্পন্ন মোবাইল ইন্টারনেট অভিজ্ঞতার জন্য বাংলাদেশে অপারেটর প্রতি কমপক্ষে ৮০ থেকে ১০০ মেগাহার্টজ বেতারতরঙ্গ থাকা প্রয়োজন। আমাদের বেশির ভাগ সাইট অথবা বিটিএস এখনো ফাইবার নেটওয়ার্ক দ্বারা সংযুক্ত নয়। এ ছাড়া সব গ্রাহকের কাছে এখনো মানসম্পন্ন ডিভাইস নেই, ইন্টারনেট ব্যবহারে সেরা অভিজ্ঞতা পেতে যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান
মুঠোফোনে ইন্টারনেটের গতিতে বাংলাদেশের অবস্থানের একটি চিত্র পাওয়া যায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওকলার কাছে, যারা প্রতি মাসে বিভিন্ন দেশের ইন্টারনেটের গতি পরীক্ষা করে তুলনামূলক চিত্র প্রকাশ করে। হিসাবে গত ডিসেম্বরে গতির দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল বিশ্বে ১৩৫তম। তারা মোট ১৩৯টি দেশের হিসাব রাখে।
সেবার মান বাড়াতে সম্প্রতি বিটিআরসি তরঙ্গ নিলাম করেছে। আগামী মাসের শুরুতে নতুন তরঙ্গ ব্যবহার শুরু করবে তিন অপারেটর গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংক। অন্যদিকে টাওয়ার বসানো নিয়ে টাওয়ার কোম্পানি ও অপারেটরের মধ্যে জটিলতা কেটেছে। টাওয়ার বসানোর কাজ চলছে।
বিটিআরসির উপপরিচালক (গণমাধ্যম) জাকির হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, গ্রাহকের সেবার মান নিশ্চিতে কমিশন সারা দেশেই পরীক্ষা চালাচ্ছে। সার্বিক চিত্র উঠে আসার পর কমিশন মান নিশ্চিতে ব্যর্থ অপারেটরদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।