‘ফোর্সেস অব ন্যাচার’ পদক বিজয়ী হলেন সেই তাহিয়াতুল

তাহিয়াতুল জান্নাত
ছবি: সংগৃহীত

রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় অনেকে তাঁকে দেখে ভূত ভূত বলে চিৎকার করত। এতে ভীষণ লজ্জা পেতেন তিনি। ভেতরে-ভেতরে ভেঙে পড়তেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় তিনি একজন ‘শ্বেতী’ রোগী। সেই তাহিয়াতুল জান্নাত এবার বাংলাদেশ থেকে ‘ফোর্সেস অব ন্যাচার’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।  

১১ অক্টোবর অনলাইনে বাংলাদেশ সময় ভোর চারটায় ফোর্স অব ন্যাচার পদক বিজয়ী হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে তাহিয়াতুলের নাম ঘোষণা করে অ্যাওয়ার্ড কর্তৃপক্ষ।
তাহিয়াতুল বলেন, অ্যাওয়ার্ড কর্তৃপক্ষও তাঁকে জানিয়েছে, এবার যুক্তরাষ্ট্র, কেনিয়া, উগান্ডাসহ মোট ১২টি দেশের নারীদের মধ্যে তিনি বিজয়ী হয়েছেন এবং বাংলাদেশ থেকে তিনিই প্রথম এ সম্মাননা পেয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলের ফটোসাংবাদিকদের রিপেল ইফেক্ট ইমেজেস নামের একটি দল নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করছে। অবহেলিত জনগোষ্ঠীর খাবার, পানি, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করা নারীদের মধ্য থেকে একজন নারীকে ফোর্সেস অব ন্যাচার পদকে সম্মানিত করা হয়।

তাহিয়াতুল বলেন, ‘কয়েক মাস আগে এ পুরস্কারের জন্য অনলাইনে আবেদন করেছিলাম। আমার কাজের তালিকা, ছবিসহ অন্য যা যা চেয়েছিল, সব জমা দিই। এরপর কয়েক দফায় অনলাইনে কয়েকজন আমার সাক্ষাৎকার নেন। এর আগে যে নারীরা এ পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁরা সবাই প্রায় অনেক বিখ্যাত। আমি বিজয়ী হব, তা ভাবতে পারিনি। তবে আমার মা শুরু থেকেই বলছিলেন, আমি এই পুরস্কার পাব।’
তিনি জানান, অ্যাওয়ার্ড হিসেবে তাঁর কাজের ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানাবে কর্তৃপক্ষ। এর বাইরে তাঁর সংগঠনের কাজ এগিয়ে নেওয়ার জন্য আর্থিক সহায়তাসহ বিভিন্নভাবে সহায়তা করবে কর্তৃপক্ষ।

এ ছাড়া ১৩ অক্টোবর করোনার সংকটে নারী স্বেচ্ছাসেবীদের অসামান্য অবদানকে স্বীকৃতি জানাতে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ১৫ জন নারীকে দেওয়া হয় ‘ইন্সপায়ারিং উইমেন ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড ২০২১’ সম্মাননা। ইউএনভি বাংলাদেশ, ভিএসও বাংলাদেশ, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এবং একশনএইড বাংলাদেশ যৌথভাবে এই সম্মাননা দিয়েছে। নানা ধাপে নির্বাচিত সেরা ৫ জন স্বেচ্ছাসেবীর মধ্যে প্রথম হন তাহিয়াতুল। পুরস্কার হিসেবে এক লাখ টাকা, ক্রেস্টসহ অন্যান্য উপহার পেয়েছেন তাহিয়াতুল।

মুঠোফোনে কথা বলার সময় হাসতে হাসতে তাহিয়াতুল বললেন, ‘সেই শ্বেতী রোগের মেয়েটিই দুই-দুইটি পুরস্কার পেয়েছে। প্রথমে আমি নিজেও তা বিশ্বাস করতে পারিনি। ফরিদপুর শহরেই একসময় আমি যাতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে না পারি, তার জন্য অন্যরা কালো তালিকাভুক্ত করারও উদ্যোগ নিয়েছিল। আর আমাকে দেখে হাসাহাসি করা তো ছিলই। ফরিদপুরে এখন পর্যন্ত আমি আমার কাজের কোনো স্বীকৃতি পাইনি। তবে দুই-দুইটি পুরস্কার পাওয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টাচ্ছে। এখন অনেকেই আমার কাজ সম্পর্কে জানতে চায়।’

শুরুটা যেভাবে করেছেন

নিজের রোগ সম্পর্কে তাহিয়াতুল বলেন, শ্বেতী ছোঁয়াচে রোগ নয়। এই রোগ সম্পর্কে কুসংস্কার ও ভুল ধারণা আছে মানুষের মধ্যে। তবে আশার কথা হচ্ছে, শ্বেতী নিয়ে অনেকের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। এরপরও রোগটি ছোঁয়াচে কি না, এ ভয়ে অনেকে কাছে আসতে চান না।

তাহিয়াতুল ২০১৬ সাল থেকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন। ‘নন্দিতা সুরক্ষা’ নামে একটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তিনি। হাসিমুখ পাঠশালা নামে একটি পাঠশালা পরিচালনা করছেন। যে পাঠশালায় ফরিদপুর সদরের হরিজনপল্লির ৩৫ জন শিশু বিনা মূল্যে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। বিনা মূল্যে নারীদের আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ, যৌন সহিংসতা প্রতিরোধে শিশুদের শরীরে অনিরাপদ স্পর্শ সম্পর্কে সচেতন করা, মাসিকের মতো বিষয় নিয়ে কথা বলার পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রেস্টুরেন্টে মাসিক সুরক্ষা ব্যাংক স্থাপন, বাল্যবিবাহ বন্ধ, এসব ছাড়াও তাহিয়াতুলের কাজের তালিকায় রয়েছে সামাজিক সচেতনতামূলক আরও অনেক কাজ।

শুরুটা সহজ ছিল না তাহিয়াতুলের জন্য। তিনি জানান, সমাজ, এমনকি পরিবার থেকেও নানা বাধা এসেছে। কিন্তু দমে যাননি তিনি। কারণ, তাঁর জানা রয়েছে, দাঁতে দাঁত চেপে চোয়াল শক্ত রেখে কীভাবে এগিয়ে যেতে হয়।

সে জন্য গায়ের রঙের তারতম্যের হিসাব, মোটা না শুকনা—এগুলো নিয়ে কথা বলা বন্ধ করতে নিজেকে লুকিয়ে না রেখে মাঠঘাট দাপিয়ে কাজ করা শুরু করেছিলেন তিনি। আর নিজেকে লুকিয়ে না রাখার স্বীকৃতি হিসেবেই মিলতে শুরু করেছে নানান সম্মাননা।

গত ৫ জানুয়ারি ‘শ্বেতীর “লজ্জা” দূরে ঠেলে তাহিয়ার পথচলা’, শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।

এসব কাজে এখন পরিবারে মা-বাবা আর এক বোন সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। বর্তমানে ফরিদপুর জেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টসহ বেশ কিছু সংস্থার সঙ্গে কাজ করছেন তাহিয়াতুল।

গত বছর মার্চে দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পর তাহিয়াতুল অনলাইনে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এর পাশাপাশি সাবান, মাস্ক, স্যানিটারি ন্যাপকিন, অন্তর্বাস, ওষুধ বিতরণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন।

করোনায় তাঁর কাজের স্বীকৃতিও পেয়েছেন তাহিয়াতুল। বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন আয়োজিত দেশসেরা ১০ জনের মধ্যে একজন হিসেবে করোনাকালীন ‘মানবিক যোদ্ধা’ পদক, আরভি ফাউন্ডেশনের ‘হিরো অ্যাওয়ার্ড’সহ অর্জন করেছেন নানা সম্মাননা।

আর যা করতে চান

তাহিয়াতুলের বাবা মনিরুজ্জামান তালুকদার ব্যাংক কর্মকর্তা। মা শামীমা আক্তার স্কুলশিক্ষক। এক বোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অপেক্ষায়। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে অনার্সপড়ুয়া তাহিয়াতুল সমাজের সুবিধাবঞ্চিত নারী ও শিশুদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করতে চান। বললেন,‘ শ্বেতী নিয়েই কাজ করে চলেছি। বাইরে রোদে কাজ করলে মুখ ও শরীরের কালো দাগ বাড়ে। তবে এ নিয়ে এখন আর চিন্তা করি না। একইভাবে আমার সবকিছু মেনে নিয়ে কেউ এগিয়ে এলে বিয়ের কথা চিন্তা করব, এর বাইরে নয়।’