ফোনে আড়ি পাতা ও ফোনালাপ ফাঁস কীভাবে হয়, দায় কার

ব্যক্তি হোক বা সংস্থার ব্যক্তিগত কথোপকথন যে–ই ফাঁস করুক, দায় নিতে হবে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা (বিটিআরসি) ও মুঠোফোনে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে। বছর দু-এক আগে হাইকোর্টে তিনজন বিচারপতির একটি বেঞ্চ এই পর্যবেক্ষণ দেন। তাঁরা বলেন, ফোনালাপ ফাঁস অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।

অবশ্য আদালতের এই রায়ের পরও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। বিরোধী দলের নেতা-কর্মী, বিরুদ্ধমত পোষণ করেন—এমন ব্যক্তিদের পর নতুন করে এ বছর এই তালিকায় সংযোজন হয়েছে সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের সঙ্গে দুজন শিল্পীর কথোপকথন। এরও মাস কয়েক আগে ফাঁস হয় দুজন পুলিশ কর্মকর্তার কথোপকথন।

চলতি বছরের ১০ আগস্ট আড়ি পাতা প্রতিরোধ ও ফাঁস হওয়া ফোনালাপের ২০টির বেশি ঘটনায় কমিটি গঠন করে তদন্তের নির্দেশনা চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের ১০ আইনজীবী রিট করেন। ওই রিট আদালত খারিজ করে দেন।

বিচারপতি মো. শওকত হোসেন, বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও এএসএম আবদুল মবিন ২০১৯ সালে রাষ্ট্র বনাম ওলি মামলায় কললিস্ট সংগ্রহ ও ফোনালাপ ফাঁস প্রসঙ্গে কথা বলেন। তাঁরা বলেন, ব্যক্তিগত আলাপচারিতা বা অন্য কোনো যোগাযোগের ক্ষেত্রে নাগরিকের অধিকার সংবিধানের ৪৩ ধারা নিশ্চিত করেছে।

কথোপকথন ফাঁস হওয়ায় কেউ ক্ষুব্ধ হলে বিটিআরসির কাছে আবেদন করতে পারেন। বিটিআরসি তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়িত্ব দিতে পারে তদন্তের। কিন্তু কেউ আবেদন করছেন না। ফলে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
সুব্রত কুমার মৈত্র

এই অধিকার নিশ্চিত করায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ও বাংলাদেশের টেলিফোন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় দায়িত্ব রয়েছে। সংবিধান স্বীকৃত কোনো আইন অনুমোদন না করলে গ্রাহকদের এবং দেশের নাগরিকদের যোগাযোগের কোনো তথ্য তারা (বিটিআরসি ও ফোন কোম্পানিগুলো) দিতে পারবে না।

যদি তদন্তের স্বার্থে কারও কললিস্ট বা এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে হয়, তাহলে কারণ উল্লেখ করে যথাযথ কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিক অনুমতি নিয়ে জব্দ করা যেতে পারে বলে অভিমত দেন বিচারকেরা।

তাঁরা বলেন, এ ক্ষেত্রেও গ্রাহককে জানানোর বাধ্যবাধকতা আছে। তদন্ত কর্মকর্তারা ঘুরে ঘুরে কিংবা ম্যালওয়্যার পাঠিয়ে (রোভিং-ফিশিং ম্যানার) এসব তথ্য সংগ্রহ করবেন না। যথাযথ প্রক্রিয়া মানা না হলে এই কললিস্ট বা এ সম্পর্কিত অন্য কোনো তথ্য আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হবে না।

কথোপকথন ফাঁসের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে সন্দেহভাজন পক্ষ মূলত দুটি। ফোনের দুই প্রান্তে থাকা ব্যক্তি ও আড়ি পাতার আইনগত ক্ষমতা যাদের আছে, তারা।
লার্ন এশিয়ার সিনিয়র পলিসি ফেলো আবু সাঈদ খান

আদালত বলেন, ‘গ্রাহকের অনুমতি না নিয়ে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে এবং জব্দ না করে কললিস্ট বা ফোনালাপ সংগ্রহ করার যে চর্চা, তা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। আমরা প্রায়ই দেখতে পাচ্ছি নাগরিকদের মধ্যকার ব্যক্তিগত কথোপকথন, তাঁদের অডিও ও ভিডিও ফাঁস হচ্ছে। সেগুলো বিভিন্ন মাধ্যমে নানা উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হচ্ছে। আমাদের অবশ্যই ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে ব্যক্তিগত আলাপচারিতা বা অন্য কোনো যোগাযোগের ক্ষেত্রে নাগরিকের অধিকার সংবিধানের ৪৩ ধারা নিশ্চিত করেছে। এটি সহজেই কোনো আগ্রহী পক্ষ প্রকাশ করতে পারে না।’

বিটিআরসির দায় কী

ফোনালাপ ফাঁসে বিটিআরসি ও মুঠোফোন কোম্পানির দায় নিয়ে আদালতের যে বক্তব্য, তা নিয়ে কথা হয় বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত কুমার মৈত্রের সঙ্গে। এখন পর্যন্ত ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনায় বিটিআরসি কী করেছে?

এমন প্রশ্নের জবাবে সুব্রত কুমার মৈত্র বলেন, কথোপকথন ফাঁস হওয়ায় কেউ ক্ষুব্ধ হলে বিটিআরসির কাছে আবেদন করতে পারেন। বিটিআরসি তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায়িত্ব দিতে পারে তদন্তের। কিন্তু কেউ আবেদন করছেন না। ফলে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এই কর্মকর্তা বলেন, তিনি মনে করেন, যিনি কথোপকথন রেকর্ড করছেন এবং যিনি প্রচার করছেন, দুজনই দায়ী। অনেক সময় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার স্বার্থে কর্তৃপক্ষ কথোপকথন রেকর্ড করতে পারে। তবে এখন সবই ফাঁস হচ্ছে।

স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিটিআরসি এ ধরনের ঘটনা তদন্ত করে দেখতে পারে কি না, কিংবা করেছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা বলেন, তিনি তাৎক্ষণিকভাবে এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবেন না।

কল রেকর্ড বা ফাঁসের পরিপ্রেক্ষিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কখনো বিটিআরসির সঙ্গে কথা বলেছে কি না, জানতে চাইলে সুব্রত কুমার মৈত্র বলেন, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি, এমন লিংক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসে। বিটিআরসি তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনুরোধে সেগুলো সরায়।

মুঠোফোন কোম্পানি ফোনালাপ ফাঁসের দায় এড়াতে পারে কি না কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কারণ দেখিয়ে কললিস্ট বা ফোনালাপ সংগ্রহ করছে কি না, জানতে চাওয়া হয় প্রথম আলোর পক্ষ থেকে। মুঠোফোন কোম্পানিগুলোর সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশের (অ্যামটব) মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম ফরহাদ (অবঃ) বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি বা গ্রাহকের কথোপকথন রেকর্ড বা ফাঁসের সক্ষমতা, এখতিয়ার কিংবা আইনগত বৈধতা কোনোটিই মোবাইল অপারেটরদের নেই। বাংলাদেশের মোবাইল সেবাদাতারা সরকারের আইন মেনেই কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে।’

তবে লার্ন এশিয়ার সিনিয়র পলিসি ফেলো আবু সাঈদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ফোনালাপ ফাঁসে বিটিআরসি ও মুঠোফোন প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় আসবে দ্বিতীয় পর্যায়ে। মুঠোফোন প্রতিষ্ঠানের দায় তার কারণ তাদের নেটওয়ার্ক থেকে ফোনালাপ ফাঁস হচ্ছে। আর বিটিআরসির দায় আছে, কারণ যোগাযোগে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার সাংবিধানিক অধিকার মানা হচ্ছে কি না, সেটি দেখার কথা বিটিআরসির।

তবে আবু সাঈদ খানের মতে, কথোপকথন ফাঁসের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে সন্দেহভাজন পক্ষ মূলত দুটি। ফোনের দুই প্রান্তে থাকা ব্যক্তি ও আড়ি পাতার আইনগত ক্ষমতা যাদের আছে, তারা।

আড়ি পাতার আইনগত ক্ষমতা কার

প্রধানত আইনপ্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অন্যের ফোনে আড়ি পাতার ক্ষমতা আছে। এই কাজে সব সংস্থাকে সহযোগিতা করে থাকে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরং সেন্টার (এনটিএমসি)।

এনটিএমসির ওয়েবসাইটে প্রতিষ্ঠানটির কাজ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশক্রমে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১ (সংশোধিত ২০১০)–এর ৯৭ (ক) ধারা মোতাবেক ক্ষমতাপ্রাপ্ত সংস্থাসমূহকে আইনানুগ ইন্টারসেপশন–সুবিধা প্রদান এবং নির্ধারিত কর্তৃপক্ষকে যোগাযোগসংক্রান্ত গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সহায়তা প্রদান।’

সাংঘর্ষিক এই আইন কাজে লাগিয়ে আড়ি পাতার কাজ নির্বিঘ্নে চালানো হচ্ছে বলে মানবাধিকার কর্মীরা অভিযোগ করেছেন।

আইনগতভাবে আড়ি পাতার ক্ষমতা আছে যাদের, তাদের দায় কতটা, জানতে কথা হয় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জিয়াউল আহসানের সঙ্গে। তিনি এনটিএমসির পরিচালক।
বৃহস্পতিবার জিয়াউল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, কথোপকথন বিভিন্নভাবে ফাঁস হতে পারে। যেমন যে দুই ব্যক্তির মধ্যে কথা হয়েছে, তাঁদের একজন ফাঁস করে দিতে পারেন। স্পিকারে রেখে অনেকে কথা বলেন, বিপদে ফেলতে কেউ কথা রেকর্ড করতে পারেন। কারও কারও ফোনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কথোপকথন রেকর্ড হওয়ার ব্যবস্থা আছে। আবার কেউ যোগাযোগপ্রক্রিয়ায় অনুপ্রবেশ করতে পারে।

আলাদাভাবে কোন ঘটনায় কে কথোপকথন ফাঁস করেছে, সেটা খোঁজ নিলে জানা যাবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এনটিএমসি পরিচালক আরও বলেন, ‘কিন্তু প্রতিমন্ত্রী সাহেবের কথোপকথন কোনো আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ফাঁস করেনি।’

যে প্রতিষ্ঠানগুলো আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আড়ি পাতে, তাদের একটি বাংলাদেশ পুলিশ। পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক মো. কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, কী প্রক্রিয়ায় কল লিস্ট সংগ্রহ বা ফোনালাপ রেকর্ড হয়, তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে তিনি জানাতে পারবেন।

চলতি বছর দুই পুলিশ কর্মকর্তারও ফোনালাপ ফাঁস হয়েছিল। কারা ফাঁস করেছিল, সে বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তর তদন্ত করে দেখেছে কি না, এমন প্রশ্নে তিনি একই জবাব দিয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র এবং প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন, এমন একটি সূত্র প্রথম আলোকে বলেছে, গ্রাহকের মুঠোফোন সুনির্দিষ্ট মোবাইল কোম্পানির টাওয়ারের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এই যোগাযোগের মাঝখানে ঢুকে পড়ার একধরনের প্রযুক্তি আছে। ওই প্রযুক্তি ব্যবহার করে কথোপকথন রেকর্ড করা হয়। ব্যক্তিপর্যায়ে বাংলাদেশে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের কোনো প্রমাণ নেই।